আরো

দেশ ছেড়ে কানাডায় আসা নতুন বাংলাদেশিরা কেমন আছেন,তার খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়!

  প্রতিনিধি ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৬:২৯:২২ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।সুমিত আহমদ।সিলেট থেকে কানাডার টরন্টোতে এসেছেন পাঁচ মাস হলো।এখনো কোনো কাজ পাননি। প্রতিদিন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন।কিন্তু কোথাও তিনি ইতিবাচক কোনো সাড়া পাচ্ছেন না।

প্রতিদিন দুবেলা করে বাংলাদেশি এলাকাখ্যাত ড্যানফোর্থে আসেন,যদি কারও মাধ্যমে কোনো কাজের সুযোগ পাওয়া যায়।এ অবস্থায় কিভাবে চলছেন জানতে চাইলে সুমিত আহমেদ বলেন, ‘সরকার যে টাকা (রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে প্রতি ব্যক্তিকে মাসে ৭০০ ডলারের মতো)দেয়, আপতত সেটা দিয়েই চলছি।’

একই অবস্থা এক সময়ের কাতার প্রবাসী হাসমত শিকদারের। তার বাড়ি সিলেটের বিয়ানী বাজারে।উন্নত জীবনের আশায় তিন মাস আগে সুমিত আহমেদের মতো তিনিও টরন্টোতে এসেছেন ভ্রমণ ভিসায়।তবে স্থায়ী হওয়ার জন্য নিজেকে ‘রিফিউজি’ দাবি করেছেন।তবে এখনও ওয়ার্ক পারমিট পাননি।তাই বৈধ কোনো কাজের সন্ধান করতে পারছেন না। কোথাও কাজ পাওয়া যায় কিনা তাই আপতত খুঁজছেন।কিন্তু সেটাও পাচ্ছেন না।একদিকে ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বাড়ি ভাড়া আর খাওয়া খরচের চিন্তায় রীতিমতো দিশেহারা তিনি। কারণ,যে টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তা প্রায় শেষের পথে।

সুমিত ও হাসমতের মতো প্রতিদিন অনেক বাংলাদেশির দেখা মেলে টরন্টোর ড্যানফোর্থ এলাকায় গেলে।সকাল থেকে রাত, যখনই যাবেন,কিছু মানুষকে পাওয়া যাবে যাদের আলোচনার মূল বিষয়ই কিভাবে,কোথায় একটা কাজ পাওয়া যাবে।এর মধ্যে আবার বড় একটা অংশ আছেন,যারা ভ্রমণ ভিসায় এসেছেন,কিন্তু স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চান।

মোট কথা,দেশ ছেড়ে কানাডায় আসা নতুন বাংলাদেশিরা কেমন আছেন,তার খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়,টরন্টোর ড্যানফোর্থ এলাকায় গেলে।ভিসার কাটাগরির ভিন্নতা থাকলেও, সবার সমস্যা এক এবং অভিন্ন – কাজ না পাওয়া।

কথা হয় ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে টরন্টোতে আসা বাংলাদেশি তরুণ সুলাইমান সাহিদের সঙ্গে।তিনি ও তার স্ত্রী দু’জনই ঢাকায় বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি ভালো বেতনে চাকরি করতেন।এক্সপ্রেস এন্ট্রির দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষ করে তারা টরন্টোতে এসেছেন গত বছরের অক্টোবরে।স্ত্রী একটা এনজিওতে চাকরি শুরু করলেও,এখনও নিজের পছন্দের কোন কাজ খুঁজে পাননি সুলাইমান।

তিনি বলছিলেন, ‘দেশ হিসেবে ইমিগ্র্যান্টদের জন্য কানাডা অবশ্যই ভালো, কিন্তু সবার জন্য নয়।বিশেষ করে,কেউ এসেই চাকরি পেয়ে যাবে- ব্যাপারটা তেমন নয়।ন্যূনতম ছয় মাস থেকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে একটা মোটামুটি মানের চাকরির জন্য।ফলে,মাঝের সময়টায় টিকে থাকার জন্য হাতে টাকা থাকতে হবে।না থাকলে কঠিন হয়ে যাবে।’

সুলাইমান বলছিলেন,গত কয়েক মাসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দরখাস্ত করেছি,কিন্তু কোথাও থেকে সেভাবে সাড়া পাচ্ছি না। আমার মতো নতুনদের নিয়ে কানাডিয়ান সরকারের অনেক ভালো ভালো প্রোগ্রাম আছে,কিন্তু সেগুলো সবই অনেক সময়সাপেক্ষ।’

বাংলাদেশের শক্তিশালী কমিউনিটি না থাকাও নতুন এসে তাড়াতাড়ি চাকরি না পাওয়ার একটা কারণ বলে মনে করেন সুলাইমান।তার মতে,ভারতীয়,কিংবা পাকিস্তানিরা নতুন এসে তাদের কমিউনিটির কাছ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা পেয়ে থাকেন,সেটা বাংলাদেশিরা পায় না।আবার দক্ষতারও অভাব আছে বলে মনে করেন সুলাইমান।বিশেষ করে,এখানে কাজ করার জন্য ন্যূনতম যে ইংরেজি জানা দরকার, বেশিরভাগেরই সেটা জানা নেই।

বাংলাদেশিদের কাজ না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সাংবাদিক গাজী সালাউদ্দিন মাহমুদ।তিনি বলেন,কানাডার মেইনস্ট্রিম যে জব মার্কেট,সেখানে কিন্তু কোনো ঘাটতি নেই। কারণ, সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করে।অর্থাৎ,এই দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, সেই পরিমাণ ইমিগ্র্যান্ট আনে। সালাউদ্দিন মাহমুদের মতে, ‘মেইনস্ট্রিম জব মার্কেটের বাইরে চাকরির সমস্যা আছে। কিন্তু সেটা বুঝতে দুটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।এক,দক্ষতা,দুই,কানাডায় আসার ভিসার ধরন।’

তিনি বলেন,গত দুই বছরে অনেক বাংলাদেশি এসেছে ভ্রমণ ভিসা নিয়ে।’

আর এই ভিসা দিয়ে বৈধভাবে কাজ পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।তবে,ভিন্নভাবে আয়-রোজগারের পথ আছে। সেটা হলো,নগদ পারিশ্রমিকে কাজ করা।আর এই নগদ টাকার কাজগুলো সাধারণত হয় কমিউনিটি-বেজ।অর্থাৎ,একজন বাংলাদেশি আরেকজন বাংলাদেশিকে ‘ক্যাশে’ কাজ দিয়ে সহযোগিতা করে,বিনিময়ে অবশ্য অনেক সস্তায় শ্রম কেনা হয়।কাজ দিতে পারেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা খুব বেশি না হওয়ায় গত দুই বছরে ভ্রমণ ভিসায় আসা মানুষের সংখ্যা যত বেড়েছে, সে তুলনায় কাজের ক্ষেত্র বাড়েনি।ফলে,এই শ্রেণির মানুষ যে কাজের সংকটে ভুগছে,তাতে সন্দেহ নেই।

আর যারা স্টুডেন্ট ভিসায় আসছেন,তাদের একটা অংশের দক্ষতার বিরাট অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সালাউদ্দিন মাহমুদ।তার মতে, ‘ভারতীয় ছেলে-মেয়েরা যত দ্রুত যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা সেটা পারে না।ফলে,যারা চাকরি দিচ্ছে, তারা বেটার পার্সনকে বেছে নিচ্ছে। আর সেখানেই পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশিরা।’

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ থেকে যারা কানাডায় এসেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ ভিসা নিয়ে।এদের একটা অংশ স্থায়ী হতে চান কানাডায়।তাদের এই স্থায়ী হওয়ার প্রক্রিয়া মোটেও সহজ না।কারণ,প্রথমত,ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বৈধভাবে কোথাও কোন কাজ পাওয়া সম্ভব নয়।কাজ পেতে তাদেরকে জব অফার ম্যানেজ করতে হবে।সেটাও হতে হবে কানাডিয়ান সরকারের তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান।বিশেষ কাজে বিশেষভাবে দক্ষ না হলে,কোনো প্রতিষ্ঠানই সাধারণত ভ্রমণ ভিসায় আসা কাউকে চাকরির জন্য বিবেচনা করে না।

ফলে ভিজিটর ভিসায় বাংলাদেশ থেকে আসা বেশিরভাগ মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা করে।কিন্তু এই প্রক্রিয়াটাও যেমন ব্যয়বহুল,তেমনি সময়সাপেক্ষ।যে কোনো একজন ভালো মানের আইনজীবীর মাধ্যমে অ্যাসাইলামের আবেদন করলে পারিশ্রমিক হিসেবে তাকে দিতে হয় ১০ থেকে ১২ হাজার কানাডিয়ান ডলার।বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৯ থেকে ১০ লক্ষ টাকা। আর এই রাজনৈতিক আশ্রয়ের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগ লাগে ন্যূনতম ৫ বছর।

তারপরও কানাডায় এসে বাংলাদেশের অনেক মানুষ বেছে নিচ্ছে এই পথ।এমনই দুজনের সঙ্গে কথা হলো টরন্টোর স্কারবরো এলাকায়।এরমধ্যে একজন শাহ ফরহাদ,আরেকজন আবুল আহসান।দুজনই এসেছেন সিলেট থেকে।সেখানে দুজনই ব্যবসা করতেন।এরমধ্যে আইনজীবীর মাধ্যমে আবুল আহসান শরণার্থী হওয়ার আবেদন করলেও আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চান শাহ ফরহাদ।তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন কানাডায় থেকে যাবেন নাকি দেশে ফিরে যাবেন।

তবে অল্প দিনের মধ্যেই তারা বুঝতে পারছেন স্বপ্ন আর বাস্তবতার ফারাক অনেক।একদিকে ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় কোথাও কোনো কাজ পাচ্ছেন না,অন্যদিকে প্রতিমাসে গুণতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের বাড়িভাড়া আর খাওয়ার খরচ। সঙ্গে আইনজীবীর খরচ তো আছেই।

এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে যাবেন কিনা জানতে চাইলে সিলেটের আবুল আহসান বলেন,ফিরে যাওয়ার আর কোন পথ নাই।যেহেতু অনেক টাকা খরচ করে এখানে এসেছি, যত কষ্টই হোক না কেন এখানেই থাকতে হবে।’

চাকরি না থাকা বিভিন্ন দেশের এমন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে কানাডার কিছু প্রতিষ্ঠান।বিভিন্ন এলাকায় তারা সপ্তাহে তিন দিন বিনামূল্যে নানারকম খাবার দিয়ে সহযোগিতা করছে। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান ‘ফিড স্কারবোরো’।মাইনাস ১০-১২ ডিগ্রি ঠান্ডার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতে দেখা যায় অনেক বাংলাদেশিকে।এই লাইনে অবশ্য অন্য অনেক দেশের মানুষকেই দেখা যায়।

আরও খবর

Sponsered content