অর্থনীতি

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রতারিত গ্রাহকের দায় কার!

  প্রতিনিধি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৩:৩৭:৪৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।গত বছরের আগস্টে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের এক এজেন্টের কাছে টাকা জমা রেখেছিলেন শারমীন আক্তার।কিন্তু সেই এজেন্ট ব্যাংকের ইনচার্জ তার জমা রাখা টাকা নিয়ে পালিয়েছেন। ইতালিপ্রবাসী স্বামীর ২২ লাখ টাকা জমা রেখে পুরোটাই খুইয়েছেন তিনি।শারমীন তার জমা রাখার টাকার বিপরীতে যে কাগজ পেয়েছিলেন,তার পুরোটাই ছিল জাল।এখন ব্যাংক বলছে,তিনি নিয়মকানুন মেনে টাকা জমা রাখেননি,তাই এর দায় ব্যাংকের ওপর বর্তায় না।এখন পর্যন্ত শারমিন তার টাকা ফেরত পাননি।

এ বিষয়ে ঐ বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরে গিয়ে কোনো গ্রাহক যদি ব্যক্তিগতভাবে এজেন্ট বা তার কর্মচারীর সঙ্গে লেনদেন করেন,তাহলে তার দায় গ্রাহকের।তবে গ্রাহক যেন টাকা ফেরত পায় সে বিষয়ে তাকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়।বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে এজেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।এখন তিনি জামিনে এসে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন।

দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে প্রায় এক দশক আগে চালু হয়েছিল এজেন্ট ব্যাংকিং।তবে এসব এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে।এসব অভিযোগ দিনকে দিন বাড়ছে।ব্যাংকগুলো জালিয়াতি ঠেকাতে এজেন্টদের ওপর যে কার্যকর নজরদারি করতে পারছে না এখন সেটাও উঠে আসছে।

তবে এজেন্ট ব্যাংকিং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন,ব্যাংকের অনেক গ্রাহক সচেতনতার সঙ্গে এজেন্ট ব্যাংকিং করছেন না। অর্থাৎ তিনি হয়তো এজেন্ট শাখায় গিয়ে টাকা জমা দিচ্ছেন কিন্তু এজেন্টের কাছ থেকে রিসিট নিচ্ছেন না।

এসব ক্ষেত্রে প্রতারণা ঘটলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এর দায় ব্যাংকের ওপর বর্তায় না।এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে,ব্যাংকিংয়ের নিয়ম মেনে টাকা জমা রাখলে তখনি শুধু ব্যাংক এর দায় নেবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন,এজেন্ট ব্যাংকিং গাইডলাইনে স্পষ্ট বলা আছে,ব্যাংক যাকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করবে তার কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই মনিটরিং করতে হবে।আর গ্রাহকদের বলা হয়েছে,যদি কোনো ব্যাংকের এজেন্টের সঙ্গে ব্যাংকিং করা হয়,তাহলে সব সময় সিস্টেম জেনারেটেড রিসিট নিতে হবে।এজেন্ট টাকা নিয়েছে এবং ব্যাংকের সিস্টেম থেকে রিসিট দিয়েছে,এই রকম ঘটনার ক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব ব্যাংকের নিতে হবে।এ ক্ষেত্রে ব্যাংক টাকা ফেরত দিতে বাধ্য। কারণ ব্যাংকের এজেন্ট যখন কোনো কার্যক্রম করছেন তখন সেটা ব্যাংকের হয়েই করছেন।কোনো এজেন্ট যদি ব্যাংকের হয়ে কোনো সেবা দিয়ে থাকেন,সে সেবার দায় এজেন্টকে নিতে হবে এবং ব্যাংককেও নিতে হবে।এক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকের গ্রাহক যদি প্রতারিত হয় এবং প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে ব্যাংককে দায় নিতে হবে।কিন্তু যদি বৈধ কোনো ডকুমেন্ট ছাড়া লেনদেন হয়,সেক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাংক নির্ধারণ করতে পারবে না যে এই লেনদেনটি হয়েছে,নাকি হয়নি।এক্ষেত্রে গ্রাহককে আইনের আশ্রয়ে যেতে হবে।মনিটরিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন,মনিটরিং কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত আছে। শতকরা হার দেখলে এরকম প্রতারণার ঘটনা খুবই কম।এখানে ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই নীতিমালা মেনে সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে এখানে গ্রাহককেও সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে,এই খাতে গত ১০ বছরে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ৩০-৪০টি আউটলেটে।তবে আউটলেট কম হলেও প্রতিটি এজেন্ট শাখার বিপরীতে সর্বস্ব খুইয়েছেন বহু গ্রাহক।তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে গ্রাহকদের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে প্রতারণার মামলা করে টাকা ফেরত পাওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। গ্রাহকরা বলছেন তাদের সমস্যাটা এখানেই।

উল্লেখ্য,সারা দেশে ২১ হাজার আউটলেটের মাধ্যমে এই সেবা দিচ্ছে তপশিলি ৩১টি ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, এই সমস্ত প্রতারণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।যেভাবেই গ্রাহক প্রতারিত হোক না কেন, তার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই নিতে হবে। তা না হলে ব্যাংকখাতের ওপর মানুষের আস্থার সংকট আরও প্রকট হতে থাকবে।

যদিও প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার পরিধি বাড়ছে।শহরের মতো গ্রামের মানুষও টাকা উত্তোলন, জমা ও রেমিট্যান্সের মতো সেবা পাচ্ছেন।বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকের প্রায় ৮৭ শতাংশই পল্লি অঞ্চলের।আর এই মাধ্যমে লেনদেন ছাড়িয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী,গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মোট হিসাব ছিল ২ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩৭টি।বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকের এজেন্ট সেবা জেলা ও উপজেলার পাশাপাশি ইউনিয়ন,পাড়া ও মহল্লা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে।সে হিসাবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানতের ৭৯ শতাংশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর।গত তিন মাসে গ্রামে আমানত বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ,শহরে এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪ শতাংশ। এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাবে এখন আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩০ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকের ৮৬ দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রাম অঞ্চলের।

এজেন্ট ব্যাংকিং কী : বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ব্রাজিলে প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয়।আর বাংলাদেশে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করে ব্যাংক এশিয়া।বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে।সেই নীতিমালা অনুযায়ী,এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে প্রত্যেক এজেন্টের একটি চলতি হিসাব থাকতে হয়।এ সেবার মাধ্যমে ছোট অঙ্কের অর্থ জমা ও উত্তোলন করা যায়।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স স্থানীয় মুদ্রায় বিতরণ,ছোট অঙ্কের ঋণ প্রদান ও আদায় এবং এককালীন জমার কাজও করেন এজেন্টরা।তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন উপযোগ সেবার বিল পরিশোধের পাশাপাশি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর অর্থও উত্তোলন করা যায়।এ ছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব খোলা,ঋণ আবেদন,ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের নথিপত্র সংগ্রহ করতে পারেন এসব এজেন্ট।

আরও খবর

Sponsered content