অর্থনীতি

ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ!

  প্রতিনিধি ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৬:১০:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নিয়েছিলেন মাত্র ৮০ হাজার টাকার ক্ষুদ্রঋণ।কিস্তি শোধ করতে ঋণ নিতে হয়েছে আরো প্রতিষ্ঠান থেকে।এখন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের সোনিয়া আক্তারের ঘাড়ে ৩০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা।শুধু সোনিয়া নয়,ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ।কেউ কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথও।

সোনিয়া আক্তার উণের বোঝা থেকে পরিত্রাণ পেতে একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন।তার কাছে ক্ষুদ্রঋন এখন তাদের মরণফাঁদ।

সোনিয়ার এই ফাঁদে পড়ার শুরুটা গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে। পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে সেখান থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋন নেন তিনি।সেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে আরো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন।সেটি শোধ করতে আরেকটি এনজিও থেকে।এভাবে ১২ টি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋন নেন তিনি। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি আর শোধ হয়নি।কিস্তি পরিশোধে ৪০ লাখ টাকার জমি বিক্রি করতে হয়েছে ১২ লাখে।

সোনিয়া বলেন,আমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।পরে ভাবীরা ধরছে।স্বামীর একটা বাড়ি ছিলো।সেই বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। তাও ঋণ শোধ করতে পারি না।

তিনি বলেন,গ্রামীণ ব্যাংক থেকে আমার শুরু।ঋণ শোধ করতে পারছিলাম দেখে হম্বিতম্বি করতো।পরে ঋণ শোধ করতে আরেক এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়েছে।

সন্তানকে বিদেশ পাঠাতে সোনিয়ার মতো গ্রামীন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন রেনু বেগমও।ঋণের বোঝা সইতে না পেরে ছেলে আত্মহত্যা করে প্রবাসে।কিস্তির টাকা শোধ করতে ঋন নেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে।সাত বছর ধরে টানছেন ঋণের বোঝা।

রেনু বেগম বলেন,আমার পোলা দ্যাখছে ঋণের লইগ্যা কেমন করে।সেই দেইখ্যা পোলাডা মইরা গ্যাছে গা।কিস্তির টাকা আজও দিতে পারি না।

পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে ঋণ নিলেও মুন্সীগঞ্জের মানুষ হয়ে পড়ছেন নিঃস্ব।ঋণ দেয়ার সময় খুব ভালো ব্যবহার করলেও,কিস্তির টাকা শোধ করতে না পারলে প্রতিষ্ঠানের লোকজনের কাছ থেকে শুনতে হয় অপমানজনক কথা। চলে মানসিক নির্যাতন।

গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীদের উপস্থিতিতেই এক নারী বলেন, কিস্তি দিতে পারেনি বলে মরতে বলছিলো।ওই লোকটা আসছিলো।

মুখে মাস্ক দিয়ে ঢেকে রাখা গ্রামীণ ব্যাংকের এক কর্মী বলেন,আমরা চাকরি করি বিধায় আসছি।

স্থানীয় এক বীর মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ,গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা গায়ে তুলতে গিয়েছিলো।আমি তাদের থামাই। বললাম, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলছি,কয়দিন পরে টাকা নেন। তখন তারা বলে ওইসব মুক্তিযোদ্ধা মানি না।

সহজ সরল মানুষগুলোকে ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে ফেলতে শ্রীনগর উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ক্ষুদ্রঋণ দাতা প্রতিষ্ঠান।কাগজ বলতে শুধু মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির অনুমোদন।তারপরই শুরু ক্ষুদ্রঋণের জাল বোনা।

এমনই এক প্রতিষ্ঠানের কর্মীর বলছেন,আমি টাকা পাবো। পাওনা টাকা দিতে হবে-এটাই কথা।

অভিযোগ পেলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়ার কথা জানান শ্রীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশারেফ হোসেন।

তিনি বলেন,সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋন নিয়ে সর্বশ্বান্ত হওয়াই শুধু নয়, প্রাণ যায় সালমা বেগমের মতো নারীদের।ঘটনা সামনে এলে শুরু হয় আলোচনা।কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে বাড়তেই থাকবে সালমাদের তালিকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে,যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২৬.৪১% বেড়েছে।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) তথ্য বলছে, এই প্রবৃদ্ধি দেশে জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও দেশের অর্থনৈতিক উত্থানকে উৎসাহিত করতে প্রান্তিক নাগরিকদের প্রচেষ্টাকে তুলে ধরেছে।

ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি,ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো সঞ্চয়েও প্রবৃদ্ধি দেখেছে।গ্রাহকরা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬২ হাজার ৫৫ কোটি টাকা জমা করে,যা আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) তুলনায় ২৫.১৬% বেশি।

নিয়ন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের অর্থবছরে বিতরণ করা ঋণের জন্য ৯৮% ঋণ পুনরুদ্ধারের হারও অর্জন করেছে। এই খাতে ৯১% ঋণ গ্রহীতা নারী বলেও জানানো হয়।

বর্তমানে, প্রায় ২৫ হাজার শাখার মাধ্যমে ৭৩১টি এমআরএ-প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যা সারা দেশে প্রায় চার কোটি প্রান্তিক গ্রাহকের কাছে পৌঁছেছে।

আরও খবর

Sponsered content