সারাদেশ

নদীভাঙন আর বারবার প্লাবনের শিকার মানুষ নদীতীরের আবাস ছেড়ে বসতি গড়ছে শহরে

  প্রতিনিধি ১৬ অক্টোবর ২০২২ , ৩:৫৭:৩১ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বছরের অধিকাংশ সময় এখন আর মেঘমুক্ত নীল আকাশের দেখা পায় না বরিশালের মানুষ। অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টির সঙ্গে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক তারতম্যে হারিয়ে গেছে ৬ ঋতুর ৩টি। বছরজুড়ে লেগে থাকা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোয়ারেই তলিয়ে যাচ্ছে নদীতীরের জনপদ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় আগের চেয়ে আরও গভীরে বসাতে হচ্ছে টিউবওয়েল।

শীত মৌসুমে লবণাক্ততা গ্রাস করছে মিঠা নদীর পানি। লবণাক্ততা বাড়ায় হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমির উর্বরতা। সেই সঙ্গে বছরের একটা দীর্ঘ সময় চাষের জমিসহ বসতবাড়ি থাকছে পানির নিচে। সবমিলিয়ে ক্রমেই বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে কয়েক কোটি মানুষের এই বিশাল আবাসভূমি। আর এসব কিছুর জন্যই দায়ী করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবকে।

কয়েক বছর আগেও বিষয়টি সম্পর্কে খুব বেশি না জানা সাধারণ মানুষও এখন প্রায় প্রতিনিয়তই অনুভব করছে প্রকৃতির ক্ষতিকর পরিবর্তন। সেই সঙ্গে বসতভিটা হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা জেঁকে বসছে তাদের মধ্যে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশন’র নির্বাহী পরিচালক আবিদুর রেজা বলেন, খুব নীরবে হলেও বাড়তে শুরু করেছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা। এটা বেশি হচ্ছে ভোলায়। নদীভাঙন আর বারবার প্লাবনের শিকার মানুষ নদীতীরের আবাস ছেড়ে বসতি গড়ছে শহরে। পটুয়াখালী-বরগুনার উপকূলবর্তী এলাকায়ও শুরু হয়েছে এই প্রক্রিয়া। ভাঙনের শিকার কিংবা বারবার ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হয়ে যারা বসতভিটা পালটাচ্ছেন তারাও কিন্তু জলবায়ু উদ্বাস্তু। হয়তো বিষয়টা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, হঠাৎ করে একদিন পানি উঠে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাবে না। দেখা যাবে উঁচু জোয়ার কিংবা প্লাবনে ওঠা পানি আর নামছে না। এভাবেই শুরু হবে তলিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। যা চলমান থাকলে ভিটেবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হবে কোটি মানুষ।

উপর্যুপরি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত উপকূল : বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাসিন্দা ইলিশ জেলে দয়াল মাঝি। ৬৫ বছর বয়সের বেশিরভাগ সময়জুড়ে মাছ ধরছেন সাগরে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও ইদানীং আবহাওয়ার খেয়ালি আচরণে বিস্মিত তিনি। দুদিন পরপর লঘুচাপ নিম্নচাপের খবর আর বিপদসংকেত ঘোষণায় ক্ষুব্ধও।

তিনি বলেন, ‘এরহম চললে তো না খাইয়া মরমু। আগে বচ্ছরে একবার-দুইবার ঝড় অইতে। এহন হারা বচ্ছর জুইড়্যা সংকেত। মাছ ধরতে যামু হেয়াওতো ঠিকমতো পারি না।’ দয়াল মাঝির মতোই বিপদে আছে উপকূলের জেলেরা। বছরবিশেক আগেও প্রকৃতির এমন উদ্ভট আচরণ দেখেনি তারা।

ইয়ুথ নেট ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ’র নির্বাহী সমন্বয়কারী সোহানুর রহমান বলেন, খেয়াল করে দেখুন, ২০০৭-এর সিডরের আগে বড় ঝড় বলতে মানুষের মনে আছে কেবল ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের কথা। অথচ সিডরের পর কতগুলো ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করেছি আমরা। মানুষের মুখে মুখে আইলা, মহাসেন, নার্গিস আর আম্পানের নাম। প্রতিমাসেই ২-৪টি লঘু আর নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছে সাগরে। যার প্রভাবে উত্তাল থাকছে সমুদ্র। বৃষ্টির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে অনিয়ম। জানমালের হুমকির মুখে পড়ছে উপকূল। বাংলাদেশ মৎস্য ট্রলার মালিক ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, আবহাওয়ার এই খেয়ালি আচরণে মৎস্য সেক্টরে সৃষ্টি হচ্ছে অচলাবস্থা। বছরের অধিকাংশ সময় সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরতে যেতে পারে না জেলেরা। যার প্রভাব পড়ছে মৎস্য উৎপাদন শিল্পে।

অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি-খরা-লবণাক্ততায় কমছে ফসলের উৎপাদন : ঢাকঢোল পিটিয়ে বসন্ত বরণ করা হলেও ফাগুনের মাতাল হাওয়ার পরশ এখন আর পায় না কেউ। শরৎ-হেমন্ত হারিয়েছে বহু আগে। অনুভূত হয় কেবল গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। আবহাওয়া বিভাগের তথ্যমতে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার সময়সীমা আর তাপমাত্রার তারতম্যেও হচ্ছে গরমিল। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এসে যখন তাপমাত্রা নাতিশীতোষ্ণ থাকার কথা তখনো গড় তাপমাত্রা থাকছে ২৫ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

একদিকে যেমন দৈর্ঘ্য বাড়ছে গ্রীষ্মের তেমনি শীত-বর্ষারও হিসাব মিলছে না। চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়নি বরিশালে। সেপ্টেম্বরের প্রথম ২২ দিনে ৩১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিকতা থাকলেও বৃষ্টি হয়েছে ৩৩৭ মিলিমিটার। অক্টোবরেও প্রায় ৫০ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। অতিবৃষ্টির পাশাপাশি অনাবৃষ্টিও ছোবল দিচ্ছে নিয়মিত। এপ্রিলে স্বাভাবিকের তুলনায় ৮৫.৬ ভাগ কম বৃষ্টি হয়েছে বরিশালে। একইভাবে মে মাসে ৫.৬, জুন মাসে ৪৪.৪৫, জুলাই মাসে ৬৫ এবং আগস্ট মাসে ১৬.৪ ভাগ অনাবৃষ্টির শিকার হয়েছে দক্ষিণ। ধারাবাহিক অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টির প্রভাব পড়ছে ফসল উৎপাদনে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি খরিপ-১ মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলায় ২ লাখ ৪ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ করা হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৪ হাজার হেক্টর কম। একই কারণে খরিপ-২ মৌসুমে কৃষি অঞ্চলে চাল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ৬.১৬ লাখ টন। আমন ফসল প্রশ্নেও ১৫ লাখ টন কম উৎপাদনে সংশয়ের মধ্যে রয়েছে কৃষি বিভাগ।

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক হৃদয়েশ্বর দত্ত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একদিকে যেমন অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি অভ্যন্তর ভাগের নদ-নদীতে বাড়ছে লবণাক্ততা। বরিশাল অঞ্চলের অধিকাংশ নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা ২ পিপিটি থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়েছে বহু আগে। লবণাক্ততা বাড়ছে ফসলি জমিতেও। যে কারণে উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে জমি। এর বিকল্প ব্যবস্থাও করছে সরকার। এরই মধ্যে লবণ সহিষ্ণু বেশ কিছু নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন করা হয়েছে। লবণাক্ততা হ্রাস-বৃদ্ধির সময় হিসাব করে উদ্ভাবিত নতুন জাতের ফসল রোপণের মাধ্যমে ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা চলছে।

বাড়ছে নদী-সাগরের উচ্চতা, কমছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ২০০৭-এর সুপার সাইক্লোন সিডরের পর থেকেই জোয়ারের উচ্চতা বাড়তে শুরু করে দক্ষিণে। বর্তমানে যা পৌঁছেছে বিপজ্জনক পর্যায়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০৪ সালে দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান ৩ নদী বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রায় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৪৫ মিটার। ২০০৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫১ মিটারে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে উচ্চতা। ২০০৭ সালে সিডরে ৪ দশমিক ১২ মিটার উঁচু হয়ে আসে জোয়ার। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় ৩ দশমিক ৬৫ মিটার উচ্চতার জোয়ার রেকর্ড করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০২১ সালের পূর্ণিমা-অমাবস্যায় ৪ দশমিক ২ মিটার উচ্চতার রেকর্ড গড়ে জোয়ার।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিকের তথ্যমতে ফি বছর ৭-৮ মিলিমিটার বাড়ছে সাগরের উচ্চতা। গত ৩০ বছরে জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছে অন্তত ৬ ফুট। যে কারণে বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ছাড়াই ঘন ঘন প্লাবিত হচ্ছে নদী ও সাগর পাড়ের নিম্নাঞ্চল।

পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ হোসেন বলেন, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আগে যেখানে উপকূলীয় এলাকায় বাঁধের উচ্চতা ছিল ৬ মিটার সেগুলো এখন ৭ দশমিক ৫০ মিটার করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভবিষ্যতের ১০০ বছর মাথায় রেখে এটা করছি আমরা। জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার বিষয়টি নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বরিশালে আগে মাটির ৭-৮শ ফুট গভীরে গেলেই মিলত বিশুদ্ধ পানি। এখন তা পেতে কোথাও কোথাও হাজার থেকে ১১শ ফুট পর্যন্ত যেতে হচ্ছে।

বাড়ছে ক্ষতি আর জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা : চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক জানায়, উপকূলীয় এলাকায় বর্তমানে স্থায়ী প্লাবনের ঝুঁকিতে আছে ২৭ ভাগ মানুষ। আগামী ৫০ বছরে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৫ ভাগে। একই সঙ্গে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলার বিস্তীর্ণ এলাকা। ক্ষতির আওতা যে কেবল সাগর পাড়েই তা নয়।

২০১৫ সালে জার্মানভিত্তিক একটি সংস্থা পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে কেবল বরিশাল নগরেই বছরে ৮০ কোটি টাকার সম্পদ ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবছর বাড়ছে এই ক্ষতির পরিমাণ। পরিবেশ ফেলো মুরাদ আহম্মেদ বলেন, মিঠা পানির নদ-নদীতে গ্রাস করছে লবণাক্ততা। যে কারণে হারিয়ে গেছে মাছের রাজা ইলিশের সেই চিরচেনা স্বাদ। আরও কতভাবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আমাদের জীবনে তা হয়তো আমরা বুঝতেও পারছি না। এখনই এটা প্রতিরোধ করা না গেলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে বহু এলাকা।

আরও খবর

Sponsered content