সম্পাদকীয়

ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকারপ্রধান বিশ্বব্যাংকে গিয়ে সম্পর্কের ৫০ পূর্তি উৎসব করেছেন!

  প্রতিনিধি ৯ মে ২০২৩ , ৩:৩৩:০৮ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।বিশ্বব্যাংকের দাওয়াতে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে গেছেন ব্যাপারটাই অন্য রকম।ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকারপ্রধান বিশ্বব্যাংকে গিয়ে সম্পর্কের ৫০ পূর্তি উৎসব করেছেন!

খরচপাতি যা গেছে পুরোটাই বাংলাদেশের,তাতে কী?স্টেট ডিপার্টমেন্ট,বিশ্বব্যাংক,আইএমএফের বক্তব্য বিকৃত হয়ে প্রচার হয়ে যাচ্ছে,তাতেই বা কী?প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার মাস কয়েক পর যাবেন ভারতে।জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তার ভারত সফরে যাওয়ার কথা।সেটির আমন্ত্রণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিয়েই রেখেছেন।

প্রধান প্রধান অর্থনীতির দেশের কৌশলগত বহুপক্ষীয় সংগঠন জি-২০-এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর এর সব সভায় বাংলাদেশকে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। ওই সফরের সময়ও একতরফা খবরের হাটবাজার বসবে। কেউ রুখতে পারবে না।

প্রধানমন্ত্রীর সফর কত সফল এবং ফলপ্রসূ হয়েছে সেই জানান দিচ্ছেন তারা। সেই সাথে প্রকারান্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপলব্ধির যথার্থতাই প্রমাণিত।

আট মাস পরে নির্বাচন। এ নিয়ে কেন হইচই।আর কোনো কাজ নাই? অনেক কিছু দেশে আছে।জলবায়ু,এমপ্লয়মেন্ট চ্যালেঞ্জ।চ্যালেঞ্জের শেষ নেই।আপনারা এগুলো না বলে বকবক করেন শুধু নির্বাচন নিয়ে। এটা খুব দুঃখজনক …

বক্তব্যটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের।প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাপান-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সফরে রওনা দেয়ার কয়েক দিন আগে কথাগুলো বলার সময় সাংবাদিকদের ব্যাপারে তার বিরক্তির পারদ ছিল বেশ তুঙ্গে।তার এ ধরনের মন্তব্য ও প্রকাশভঙ্গিতে কষ্ট পেয়েছেন সাংবাদিকরা।

দিন কয়েকের মধ্যেই তাদের কষ্ট কেটে গেছে।তাদের বা তাদের নেতাদের বেশ ক’জন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে এখন রাজমেহমান।আসলেই আরো কত ঘটনা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্যচক্র তার প্রতিপক্ষের জন্য অত্যন্ত ঈর্ষার। তিনি যা করেন সেটাই বরকতময়,যা বলেন সেটাই মধুর। কখনো কখনো তিক্ত হলেও নানা যুক্তিতে সেটাকে মিষ্টিমধুর ও দশ কথার এক কথা বলে প্রমাণ করে দেয়ার জন্য দেশে প্রচুর লোক ও ব্যবস্থা আছে।করোনা,বিশ্বমন্দা,বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধ সব কিছুর মধ্যেই তার জন্য আশীর্বাদের মালসামানায় ভরা। সময়টাও ঘটনা।বাংলাদেশ এখন বিশ্ব ভূগোলের হাই প্রোফাইলের দেশ।বাংলাদেশ নিয়ে বড্ড ব্যস্ত এক্সিলেন্সিরা। কেবল ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতই নন,যারপরনাই ব্যস্ততায় ওইসব দেশের মান্যবররাও।একজন যেতে না যেতেই আরেকজন ছুটে আসছেন।কখনো কখনো একজন থাকতে থাকতেই চলে আসেন আরেকজন বা অন্য কোনো জন।এর পুরো সুফলটা নিচ্ছে বাংলাদেশ।

বিশ্ব পরাশক্তির অন্যতম দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা থেকে ইউরোপ-জার্মানি পর্যন্ত সবার কাছেই এখন ভিন্ন উচ্চতার ভ্যালু বাংলাদেশের।এর রসায়নেই এক্সিলেন্সিরা শুধু বাংলাদেশের কোনো ব্যাপার নিয়েই আসছেন-যাচ্ছেন, এমন নয়।তাদেরও এজেন্ডা আছে।ঝানু কূটনীতিকদের কাছে এ-সংক্রান্ত তথ্য ও বিশ্লেষণের অনেক রসদ।এর নেপথ্য বেশ গভীরে হলেও দুর্বোধ্য নয়।নতুন স্নাযুযুদ্ধের সময় পুরনো অনেক হিসাব পাল্টে গেছে।বদলে গেছে শত্রু-বন্ধুর সংজ্ঞাও। কাউকে ছোট বা গুরুত্বহীন ভাবার দিন ফুরিয়ে গেছে।কারো জন্য যা মঙ্গলের,আরেকজনের জন্য তা আশীর্বাদের। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বর্তমান সরকারের বেশ টানাপড়েনের মধ্যেও শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরে গেছেন।যুক্তরাষ্ট্র আমন্ত্রণ না জানালেও যে দেশটিতে রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়া যায় শেখ হাসিনা তা করে দেখিয়েছেন।বিশ্বব্যাংক থেকে কিভাবে আমন্ত্রণ জোগাড় করে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাওয়া যায় সেটা সংশ্লিষ্টরা জানেন।আবার একসাথে মার্কিন ও চীন রিলেশন চ্যালেঞ্জিং অকল্পনীয়।শেখ হাসিনা সেটাও করে যাচ্ছেন সাফল্যের সাথে।

বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার চিপায় চ্যাপ্টা হওয়ার বদলে সক্ষমতার জানান দিচ্ছেন অবিরাম। যার ভিত্তি বা ম্যাজিক লুকানো বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে।চলমান স্নায়ুচাপে বিভক্ত বিশ্বে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক দিন দিন গভীর হচ্ছে। ভারত আছে ব্যালেন্সে। ইউরোপের রণাঙ্গনে রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধ করছে ন্যাটো দিয়ে।আর এশিয়ায় চীনকে অ্যালায়েন্স দিয়ে রুখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।ক্রমে মিয়ানমার ধেয়ে চলছে আরেকটি ভিয়েতনামের পথে। এসবের নির্যাস থেকে কেবল রক্ষা নয়,লাভবান হওয়ার সোপানে সরকার। খটকাটা লেগে আছে যুক্তরাষ্ট্রে। জাপান সফর শেষ করে শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ১ মে, বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যকার সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সময় বিশ্বব্যাংক সদর দফতরের সামনে ঝামেলা বাধায় সেখানকার বিএনপি।তারা বিক্ষোভ শুরু করলে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরাও তেড়ে যায়।বাধে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ। কয়েকজন আহত হন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, এতে জড়িত সন্দেহে স্থানীয় পুলিশ দুই দলের তিন সমর্থককে গ্রেফতার করে।পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।এ নিয়ে খবর দু’ধরনের। সরকারি আয়োজনের খবর হচ্ছে,প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিক্ষোভকারীদের কথা বলার জন্য কাছে ডেকেছিলেন।কিন্তু তারা ভয়ে চম্পট দিয়েছে।আর বিএনপি নেতাকর্মীদের মন্তব্য হচ্ছে- এই প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাদের কোনো কথা নেই।তাদের কর্মসূচি ছিল বিক্ষোভ জানানো।সেটা করে তারা চলে গেছেন।

বর্তমান সরকারপক্ষের সংবাদ ব্যবস্থাপনার সাথে অন্য কারো তুলনা খাটে না।এ কাজে তারা আনপ্যারালাল চ্যাম্পিয়ন। কেবল বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ নয়,মার্কিন স্টেট ডিপার্টেমেন্টের বক্তব্য-বিবৃতি সূক্ষ্মভাবে নিজেদের সুবিধামতো প্রচারের ব্যবস্থা করার দক্ষতাসম্পন্ন তারা।পরিস্থিতির অনিবার্যতায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরকেও কখনো কখনো পরে আবার কথা বলে আগের বক্তব্য পরিষ্কার করতে হয়।প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র থাকালেই এবার দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের উপ-প্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের বক্তব্য নিয়ে রীতিমতো বাঙালি কাণ্ড ঘটে গেছে।তার বরাতে প্রচার হয়েছে,বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করতে চায় না জানিয়ে এই নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও ঘরোয়া বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।তার এ বক্তব্যের পরে অংশে একটি ‘তবে’ ছিল।সেটি এ রকম… তবে, যুক্তরাষ্ট্র চায় যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক এবং এতে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটুক।’

এ বক্তব্যের পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য ও বক্তব্যের সয়লাব বয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মী বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের কটাক্ষ করে অনেক মন্তব্য করেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র তার বক্তব্য স্পষ্ট করেন।সেখানে বলা হয়, … মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করে এবং আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে সমর্থন করি না।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের এমন সূক্ষ্ম চালাকি-চাতুরি বা কূটনীতির প্যাঁচ শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে তা এখনই বলা যায় না।তবে বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিপাতের আয়োজন বেশ কড়া।বাংলাদেশের মসৃণ উত্তরণের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।আবার পদ্মা সেতুর চমৎকার একটি ছবিও গিফট করা হয়েছে বিশ্ব্যাংককে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতুর ছবি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের হাতে তুলে দেয়া ছবিটি ভাইরাল হয়েছে।কিন্তু বাংলাদেশে খবর ছড়ানো হয়েছে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রশ্নে অনুতাপ প্রকাশ করেছে।কমবেশি তা খবরের বাজার পাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। এর মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ,দুর্যোগ প্রস্তুতি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংকের ২২৫ কোটি (২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণের খবরটি ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় বিষয়। এসংক্রান্ত প্রচারণা বেশ জোরদার।

বিশ্বব্যাংককে একটি নেতৃস্থানীয় উন্নয়ন অংশীদার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের কাছে বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নে আরো সহায়তা চেয়েছেন।তাকে ‘টানা তিন মেয়াদ’ দেশের সেবা করার সুযোগ লাভের জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন শেখ হাসিনা।এ স্টাইলে বিশ্বব্যাংকের প্রশংসার সবসময়ে আইএমএফের কাছেও তার কৃতজ্ঞতার পর্ব রয়েছে।বলেছেন,আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশকে স্বস্তি দিয়েছে। এ ধরনের স্তুতি ও বন্দনার বাক্য- শব্দ পরে ঠিক থাকে না।ঝামেলা দেখা দিলে বলা হয়, কথাটি সংশ্লিষ্টরা এভাবে বলেননি।মানুষও তদ্দিনে তা ভুলে যায়।গত কিছুদিন ধরে এ ধরনের সংবাদ নিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশনগুলোতে একতরফা প্রচারই একধরনের নিয়ম হয়ে গেছে।তাদের অনলাইন ভার্সনেও তাই।এক জায়গা থেকে সরবরাহ করা রিপোর্ট নানা মিডিয়া অনেকটা আরোপিতভাবে প্রচার করে। আর সোশ্যাল মিডিয়া করে পক্ষে বা বিপক্ষে অতিরঞ্জন। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর নিয়ে এ প্রবণতা আরো বেশি। গণমাধ্যমের জন্য এটি বড় বেদনার।আর মানুষের জন্য অস্বস্তির।

তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট সুত্র:—–

আরও খবর

Sponsered content