সম্পাদকীয়

আশায় আশায় দিন যায়-কিন্তু প্রকল্পের গতি আর এগোয় না!

  প্রতিনিধি ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ , ১:১৫:৩৯ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।ঢাকা উড়াল সড়ক বা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (পিপিপি) প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল।মূল অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা।পরে এই প্রকল্পের মেয়াদ বার বার বাড়ানো হয়েছে।সর্বশেষ মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা।প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৭০১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।অতিরিক্ত ব্যয়ের ১০ প্রকল্পের মধ্যে এটি রয়েছে।এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে বেশি টাকা লাগবে।তাই ব্যয় বেড়েছে।এই প্রকল্পের কাজ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল।ধীরগতির ফলে বার বার উদ্বোধন আর প্রতিশ্রুতির মধ্যেই ঘুরছে এই ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন।

দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে একে একে।পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়েছে গত জুন থেকে।তার প্রায় ছয় মাসের ব্যবধানে চালু হচ্ছে দেশের প্রথম মেট্টোরেল যা ঢাকার যানজট নিরসনে এটি সহায়ক হবে।চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজও শেষের দিকে।

উন্নয়ন অভিযানের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে।তবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা অর্জনের পথ এখনো বাকি।সেই সঙ্গে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সংস্থাগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সঙ্গে অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ের অভাব।এ কারণে কোনো কোনো প্রকল্প প্রতিশ্রুতির বৃত্তেই ঘুরতে থাকে।জনপ্রতিনিধিরাও আশার বৃত্তে ঘুরতে থাকেন।এসব প্রকল্প ‘আশার ফাঁদ‘ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।আশায় আশায় দিন যায় কিন্তু প্রকল্পের গতি আর এগোয় না।এমনি একটি প্রকল্প- ঢাকা উড়াল সড়ক বা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ১১ বছরেও এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি।

অথচ দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে চালু হয়েছে।এক্সপ্রেসওয়ে ধরে যাতায়াত করে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন।কিন্তু অবরুদ্ধ ঢাকাকে এতটুকু মুক্ত করার আশা নিয়ে শুরু করা ঢাকা উড়াল সড়কের কাজ বড় বিলম্বের মুখেই রয়েছে।

রাজধানী ঢাকা হাঁটছে।অথচ এই মহানগরীর ছোটাছুটি করার কথা।একজন মানুষ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারেন।রাজধানী ঢাকায় যানবাহনের চলাচলের গতি মানুষের হেঁটে চলার মতো নয়।এই রাজধানী শহরের অবরুদ্ধ অবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প নিয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে যে মেট্রোরেল চালু হচ্ছে তা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে।পরে এটি কমলাপুর পর্যন্ত চালু করা হবে। বিজয়ের মাসে এই প্রকল্পের দৃশ্যমান অগ্রগতি,তা চালুর বিষয়টি দেশবাসীকে আশান্বিত করছে।কিন্তু ঢাকা উড়াল সড়কের ধীরগতিতে একটা প্রশ্ন তীরের মতো ছুটে আসে মনের মধ্যে-আর কত দিন লাগবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে?

এ নিয়ে এর আগেও লিখতে হয়েছে।খোঁজ নিয়ে যেটা জানতে পারলাম তা হচ্ছে-মূলতঃ ভুল পরিকল্পনা এবং ভূমি অধিগ্রহণে অদক্ষতার ফলেই প্রকল্পের কাজ সময়ে সময়ে প্রক্রিয়ার ফাঁদে আটকে গেছে।শুধু প্রাইভেট কার চলাচলের জন্য বেশি সুবিধা মিলবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে।এছাড়া নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিলম্বে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার ফলে তা জনভোগান্তির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি টাকার অপচয়ও ঘটাচ্ছে।

প্রথমে নেওয়া পরিকল্পনাটি ছিল ভুল।ভূমি অধিগ্রহণের ব্যর্থতার ফলে প্রকল্পের সংযোগপথ বা র‌্যাম্পগুলো নির্মাণ করতে হচ্ছে পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুসারে।এরইমধ্যে এক দশক সময় চলে গেছে।

২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়।প্রকল্পের প্রধান অংশ কাওলা-বনানী ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার অংশের কাজ শেষ হয়নি।প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। তৃতীয় ধাপ মগবাজার লেভেল ক্রসিং থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এসব অংশে প্রকল্পের কাজ সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি।

চার লেনের উড়াল সড়কটির প্রারম্ভিক স্থান রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীতে কাওলায়। কাওলা থেকে শুরু হয়ে খিলক্ষেত,কুড়িল,মহাখালী, তেজগাঁও,মগবাজার,কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে কুতুবখালি পর্যন্ত যাবে সড়কটি।১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে উড়াল সড়কটি।এতে থাকছে উঠা-নামার জন্য ৩১টি র‌্যাম্প এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার।এসব সংযোগ পথ বা র‌্যাম্পসহ উড়ালসড়ক ৪৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটারের।

আমরা জানতে পেরেছি,সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এজন্য ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ।২০১৩ সালে প্রকল্প এলাকায় ভূমি জরিপ শুরু হয়।তবে দুই ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় চলে যায় দুই বছর।উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব-ডিপিপি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তিন হাজার ২১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল মূল প্রকল্পে। ২০১১ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার লক্ষণই দেখা যায়নি।পরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে তা দাঁড়ায় চার হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা।সময় বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।তারপরও আবার প্রকল্প ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সালের জুন অবধি।এই উড়াল সড়কে যানবাহন চালাতে হলে টোল দিতে হবে।বিমানবন্দরের কাছে প্রকল্পের প্রারম্ভিক প্রান্ত থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত এ সড়কে ব্যক্তিগত গাড়িতে টোল ধার্য করা হয়েছে ১২৫ টাকা।সর্বনিম্ন টোল ১০০ টাকা।প্রতি বাসের জন্য ২৫০ টাকা।প্রতি ট্রাকে, শ্রেণি অনুসারে টোল দিতে হবে ৪০০ ও ৫০০ টাকা।ট্রেইলারের জন্য ধার্য হয়েছে ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা।

উড়ালসড়কটিতে ১১টি টোল প্লাজা থাকবে।যার পাঁচটিই হবে উড়ালসড়কের ওপর।এর ওপর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে।কিন্তু সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়।

চলতি ডিসেম্বরে প্রকল্পের বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অংশ চালুর লক্ষ্য ছিল।বনানী থেকে তেজগাঁও অংশে ৫০ শতাংশ কাজ এখনো বাকি। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন,রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে। অথচ এ ধরনের প্রকল্পে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অনুসরণ করা উচিত। বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার।এই অংশের ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।এখন চলছে স্লাবের উপর ঢালাইয়ের কাজ।বনানী থেকে তেজগাঁওয়ে উঠেছে ভায়াডাক্ট। কয়েকটি অংশে পিলার বসানোর কাজ এখনো বাকি।

আমরা আশা করব- এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে ‘ধীরগতি’ দূর করতে সংশ্লিষ্টরা উদ্যোগ নেবেন।কারণ পুরো ঢাকা শহরের ব্যস্ত এলাকাগুলোয় কোনো কোনো সময় যান চলাচল বন্ধ রেখেও প্রকল্পের কাজ হতে দেখা গেছে। এটা এক ধরনের ভোগান্তি-এ থেকে রেহাই চায় মানুষজন। আমরা এবার ঢাকা উড়াল সড়ক বাস্তবায়নে উড়ন্ত গতি চাই। কারণ এই প্রকল্প যদিও প্রাইভেট কার বান্ধব তবুও বলবো- যানজটে ঢাকার অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে আমরা কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবো এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে।

আরও খবর

Sponsered content