সম্পাদকীয়

বাংলা বর্ষ প্রণয়ন থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা পর্যন্ত পথচলা

  প্রতিনিধি ১৪ এপ্রিল ২০২৩ , ৯:৫৬:২১ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।শুভ নববর্ষ ১৪৩০।নববর্ষ বরণ কোন ধর্মীয় উৎসব নয় এটি হিন্দু – মুসলিম – খৃষ্টান – বুদ্ধিস্ট সকল বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব।পৃথিবীতে যত বর্ষ গণনা আছে,তার অধিকাংশই ধর্মকেন্দ্রিক যেমন ইংরেজি বর্ষ খ্রিস্টীয়,হিজরী বছর ইসলামিক,আবার হিন্দি বা সংস্কৃতি বছর আর্য ব্যবস্থাপনা বা সনাতনি।কিন্তু বাংলা বছর কোন ধর্মীয় বেজে গড়ে ওঠে নাই।

বাংলা বর্ষ প্রণয়ন থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা পর্যন্ত পথচলা ।============== বাংলার মুসলমান,বাংলর হিন্দু,বাংলার বৌদ্ধ,বাংলার খ্রিস্টান,আমরা সবাই বাঙ্গালী।বাংলা মোদের পরিচয় বাংলা মোদের প্রাণ।বাংলার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি আছে,বাঙালির আবেগ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম,পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি ভাষার জন্য রক্ত দান করেছে,সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ একসাথে সম্প্রীতিময় বসবাস।

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার হবার পর কৃষকদের কাছ থেকে কর গ্রহণ করা হতো হিজরী বছর মোতাবেক,হিজরী বছর চাঁদের উপর নির্ভর হওয়ার কারণে ১০ দিন করে প্রতিবছরে ব্যবধান বাড়তে থাকে,এই কারণে কর দেবার সময় টি একেক বছরে একেক ঋতুতে পড়ে যায়,এতে কৃষকদের অর্থনৈতিক সমস্যা হয়,আবার আদায়ের ক্ষেত্রে ভূস্বামীদের সমস্যাও হতো।

এ বিবেচনায় মোগল সম্রাট আকবর তার শাসনামলে ১৯ তম বছরে বাংলা সাল প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন,এ বিষয়ে কাজ করার জন্য দায়িত্ব দেন তৎকালীন প্রখ্যাত জ্যোতিষবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজীকে।তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি জ্যোতিষ ছক সৃষ্টি করেন,এই এলাকাটি ছিল ঋতু নির্ভর এবং ছয় ঋতুর দেশ, সেটিকে ঠিক রাখতে এই এলাকার পূর্বের প্রচলিত সৌর বছর কে আংশিক গ্রহণ করেন এবং চাঁদের হিসাবে হিজরী বছরকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষকের উপযোগী করে একটি নতুন বর্ষছক সৃষ্টি করেন।

সেটি সম্রাট আকবরের কাছে উপস্থাপন করলে সম্রাট আকবর তা গ্রহণ করেন এবং বাংলা বছর হিসেবে এলানজারি (ঘোষণা) করেন,পৃথিবীতে নতুন বছরগননা বাংলা বর্ষের যাত্রা শুরু হলো।এটি বাংলা শতাব্দি হিসাবে পরিচিত লাভ করল,এটির মূল ভিত্তি চাঁদের উপর নির্ভরশীল হিজরী সন, হিজরী ৯৬৩ সন কে বাংলা সনের প্রথম বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

চৈত্র মাসের শেষ দিনে কৃষকের কাছ থেকে জমিদার, তালুকদার,অন্যান্য ভূস্বামীগন কর/খাজনা গ্রহণ করেন এবং পহেলা বৈশাখে কৃষকদেরকে মিষ্টিমুখ করান এটি রীতিতে পরিণত হয়।বেশ কিছু সময় পর এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার সাথে বাংলা বছরকে সংযুক্ত করে,সারা বছরের হিসাব শেষে পহেলা বৈশাখের দিন নতুন ও পুরাতন ব্যবসায়ীদেরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন খাতায় নাম লিখা হয়,নাম হয় হালখাতা।

কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সাথেই সমগ্র বাঙ্গালীদের নিজস্ব উৎসব হিসেবে বাংলা নববর্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়। নববর্ষের দিন সকল ধর্ম বর্ণের বাঙালিরা নতুন পোশাক পরিধান করত,ধনী-দরিদ্র প্রত্যেকের বাড়িতেই ভালো খাবার পরিবেশন,আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ,পরিবারের সকলের কল্যানে নিজ নিজ ধর্মে প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা ও দোয়া রীতিতে পরিণত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ দের বিজয় কামনা করে ভারতবর্ষে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়।আমাদের দেশে ১৯৬৫ সালে বর্ষবরণ প্রথম রমনার বটমূলে ছায়ানটের ব্যবস্থাপনা চালু হয়।১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ই এপ্রিল বাংলা নববর্ষ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।১৯৯৬ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা রমনার বটমূল থাকে ছায়ানটের ব্যবস্থাপনায় বাংলার সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করে যাত্রা শুরু হয় যা জাতিসংঘের ইউনেস্কোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

নববর্ষ বরণ কোন ধর্মীয় উৎসব নয় এটি হিন্দু – মুসলিম – খৃষ্টান – বুদ্ধিস্ট সকল বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব।যারা এই উৎসবের বিরোধিতা করেন তাদের জেনে রাখা দরকার বাঙালির হাজার বছরের প্রাণশক্তি বর্ষবরণ উৎসব।মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালের ১০/১১ ই মার্চ হিজরী সন কে মূল ভিত্তি করে এই বাংলা বছরের সৃষ্টি করেছিলেন,পৃথিবী যতদিন থাকবে,বাঙালি যতদিন থাকবে,বাংলা বর্ষবরন বাঙালির হৃদয়ের প্রাণশক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতির মহান ব্যক্তিত্ব আর্যদেব পা, ভিষুক পা, কুক্কুরি পা,সাহ মোহাম্মদ সগীর,কৃত্তিদাস ওঝা,আবব্দুল হামিদ,বড়ু চন্ডিদাস,ভারতচন্দ্র বসু,প‍্যারীচাঁদ মিত্র,মাইকেল মধুসুধন দত্ত,দীনবন্ধু মিত্র,হাসান রাজা,জতিৎরিন্দ্র নাথ, দ্বীজেন্দ্রনাথ রায়,স্বামী বিবেকানন্দ,প্রথম চৌধুরী,আব্দুল করিম সহিত‍্যবিষারদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজি,নিরুপমা দেবী,মোহাম্মদ লুৎফর রহমান,কাজী মোতাহার হোসেন, জীবনানন্দ দাস,রাজা রামমোহন,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল ইসলাম,কবি জসিম উদ্দিন,বেগম রোকেয়া,সুফি সম্রাট ফকির লালন শাহ,আরজ আলী মাত্তবর,আবু জাফর শামসুদ্দীন,ফাররোখ আহমেদ,মানিক বন্দোপধ‍্যায়,নীলিমা ইব্রাহিম,মুনীর চৌধুরী,আনোয়ার পাশা, জাহানারা ঈমাম,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,জহির রায়হানআহমেদ ছফা,মুহাম্মদ জাফর ইকবাল,মঈনুল আহমেদ সায়ের, নির্মেলন্দু গুন,কবি শামসুর রহমান,বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ বাংলা সাহিত্যিকদের পরম স্পর্শে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি,এত শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ানো যে,কখনো কখনো বাঙ্গালীকে বিভ্রান্ত করা যায়,কিন্তু দিনশেষে বাঙালি সংস্কৃতির মেল বন্ধন,সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে,বাঙালিত্বকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করায়,কাজেই কোন অপশক্তির পক্ষেই বাঙালি বর্ষবরণ কে রুদ্ধ করা সম্ভব হয় নাই,হবেও না।।

আরও খবর

Sponsered content