সম্পাদকীয়

গুজব হলো, স্ত্রীর একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে

  প্রতিনিধি ১১ অক্টোবর ২০২২ , ২:৪৬:৪৮ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।ইরানের একটা ছোট্ট গ্রাম। ওখানে সুরাইয়ার সংসার। স্বামী, দুই কন্যা আর দুই পুত্র সন্তান। স্বামীর হঠাৎ নজর পড়ে চৌদ্দ বৎসর বয়সী এক কিশোরীর ওপর। তাকে বিয়ে করার আকাঙ্খা মাথায় চাপে। কিন্তু ঘরে স্ত্রী থাকতে আরেকটা বিয়ে করা ঝামেলা। খরচাপাতিও বেশী। তখন স্বামী ফন্দি আঁটে। গ্রামের সর্দারের সাথে বোঝাপড়া করে। এবং নিজের স্ত্রীর নামে গুজব রটিয়ে দেয়। গুজব হলো, স্ত্রীর একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে। গুজব শক্তিশালী করার জন্য হুমকি ধমকি দিয়ে সাক্ষীও জোগাড় করে। সুরাইয়ার অপরাধ প্রমাণিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী সুরাইয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডটা ভয়ানক। প্রকাশ্যে রাস্তায় গর্ত খোঁড়া হয়। সুরাইয়ার হাত পা বাঁধা হয়। গর্তে কোমর পর্যন্ত পোঁতা হয় তাকে। মাটি দিয়ে ভরাট করা হয় চারপাশ। তারপর দূর থেকে পাথর ছোঁড়া হয় শরীর উদ্দেশ্য করে। প্রথম পাথর ছুঁড়তে হয় সুরাইয়ার পিতাকেই। তারপর একেক করে সবাই। এমনকি সুরাইয়ার দুই পুত্রকেও জোর করে পাথর ছুঁড়তে বাধ্য করা হয় মায়ের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনর্গল পাথর ছোঁড়ার পর সুরাইয়ার চারপাশের মাটি লাল হয়ে আসে, ছিঁটে ছিঁটে রক্ত পড়ে। শরীরের নাড়াচাড়া বন্ধ হয়। তখন স্বামী উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সুরাইয়ার রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে পরীক্ষা করে, সে বেঁচে আছে কিনা। সুরাইয়া বেঁচে ছিল অমন ক্ষত বিক্ষত হওয়ার পরও। চোখ খুলেছিল। তখনও মরেনি বুঝতে পেরে স্বামী সহ গ্রামের সবাই সুরাইয়ার আশপাশে পড়ে থাকা রক্তাক্ত পাথর কুড়িয়ে নিয়ে পুনরায় ছুঁড়তে শুরু করে। সুরাইয়ার মৃত্যু হয় অতঃপর।

এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি লিখেন একজন ইরানি লেখক। নাম, ফ্রিদৌনি সাহেবজাম। সময়, উনিশশো নব্বই সাল। বইটি ইরান ব্যান করে দেয়। বাস্তবিক একটা ঘটনার আদলে লেখা এই বই ইন্টারন্যাশনাল বেস্টসেলার হয়। দুই হাজার আট সালে এই বইটি স্ক্রিনে আনা হয় প্রথমবার। একটা সিনেমা বানানো হয়। নাম, “দ্য স্টোনিং অফ সুরাইয়া এম”। প্রায় ছয়শো সিনেমার শর্ট রিভিউ আছে আমার। অনেক আগে দেখার পরও, কখনও এই সিনেমা সম্পর্কে বলিনি কাউকে। কারণ, এই সিনেমা কার মগজে কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তার কোনো ধারণাই আমার নেই। অহরহ স্ল্যাশার গেলা আমারই এই সিনেমা হজম হয়নি।

আমাদের প্রজন্ম চিন্তাভাবনা করে। বসে বসে গণ্ডি নির্ধারণ করে। সংস্কৃতি, শালীনতা, অশালীনতার সংজ্ঞা আওড়ায়। ধর্ষণের কারণ খুঁজে। সমস্যার উপায় খুঁজে। আঙুল তোলে, আর দেখায়, কিভাবে নারী নিরাপদ, কোথায় নারী নিরাপদ।

আজ আমার ওদের জানাতে ইচ্ছে করল, সারা গা আবৃত করে চলাফেরা করা একটা দেশে এক মধ্যবয়সী নারীকে পুরো গ্রাম পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরে ফেলেছিল শুধুমাত্র একটা অপবাদ শুনে। যে অপবাদের এক ছটাক সত্যতাও ছিল না। ঐ নারী মৃত্যুর আগে সম্মুখে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখা দোপেয়ে’দের একটি প্রশ্ন করে গিয়েছিলেন।

আরও খবর

Sponsered content