আবহাওয়া বার্তা

শুধু বর্ষা নয়,শীতেও বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা

  প্রতিনিধি ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৩:৫০:৩০ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে’—বর্ষার নবধারাকে এভাবেই আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।প্রতিবছর গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পর প্রকৃতিকে শীতল করে বর্ষার ধারা।কিন্তু গত চার দশকের আবহাওয়া পরিস্থিতির বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশে এখন বর্ষার সময়ও তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।বর্ষা আসার সময় পাল্টে যাচ্ছে,বর্ষা বিদায়ও নিচ্ছে দেরিতে।

শুধু বর্ষা নয়,শীতেও বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা।মেঘাচ্ছন্ন দিনের পরিমাণ বাড়ছে।এর ফলে শীতের দিনে তাপ বাড়লেও শীতের তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে।এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রায় বছরজুড়ে বায়ুদূষণ।

‘বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু: আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের প্রবণতা এবং পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণায় প্রকৃতিতে পরিবর্তনের এসব চিত্র উঠে এসেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন।তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ ও নরওয়ের আরও পাঁচজন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে এই গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় পাওয়া পর্যবেক্ষণ আবহাওয়া অধিদপ্তরের উদ্যোগে ঢাকায় আজ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে।

দেশে আবহাওয়া অধিদপ্তরের যতগুলো কেন্দ্র (কার্যালয় বা স্টেশন) আছে,সেখান থেকে এই গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ। তিনি বলেন,চার দশকের বেশি সময়ের আবহাওয়ার পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণে আমরা নানা ধরনের পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি।এর মধ্যে আছে তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি,বৃষ্টিপাতের ধরন,সূর্যালোক ও মেঘের প্রবণতার পরিবর্তন।’

গত চার দশকে আবহাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন হয়েছে, তাতে ডেঙ্গুর মতো কীটপতঙ্গবাহিত নানা রোগ দেশে বেড়ে যাচ্ছে।কৃষি খাতেও নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিচ্ছে বলে জানান গবেষক ও কীটতত্ত্ববিদেরা।

বাংলাদেশে ১৯৬০-এর দশকে প্রথম ডেঙ্গু রোগের বিস্তার হয়। এরপর ২০০০ সাল থেকে এ রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

কীটপতঙ্গবাহী নানা রোগের বিস্তারের ক্ষেত্রে বর্ষার সময় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এর দেরিতে আসা ও যাওয়ার সম্পর্ক আছে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।

তাপমাত্রার পরিবর্তন

তাপমাত্রার পরিবর্তন বুঝতে দেশের ৩৫টি আবহাওয়া স্টেশনের ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের প্রতিদিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দেখা হয়েছে।সেখানে বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রার পরিবর্তনের দিকটি উঠে এসেছে। সব ঋতুতেই তাপমাত্রা আগের চেয়ে বাড়ছে।

ঢাকার তাপমাত্রার ক্ষেত্রে ৪০ বছরে দেখা গেছে প্রাক্‌-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী তিন সময়েই প্রতি দশকেই তাপমাত্রা সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৯,শূন্য দশমিক ৩৩ এবং শূন্য দশমিক ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।শুধু শীতকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমে গেছে শূন্য দশমিক ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগেই বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে।এর মধ্যে খরাপ্রবণ রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রতি দশকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে,শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।বৃষ্টিবহুল সিলেটেও একই মাত্রা তাপমাত্রা বেড়েছে।ঢাকা,রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি দশকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের সাইফুল ইসলাম বলেন,বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ গবেষণার পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের কৃষি,পানি ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে পরিকল্পনার জন্য গবেষণায় আসা বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যৎ নীতিমালা নির্ধারণে সহায়তা করতে পারে।

এর মধ্যে গত ৪০ বছরে রংপুর বিভাগে সূর্যালোক সবচেয়ে বেশি কমেছে।এরপর সূর্যালোক কমেছে ঢাকা,ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগে।

সূর্যালোক কমছে,বাড়ছে মেঘ,বাড়ছে দূষণ

সূর্যালোক (দিনে সূর্যের আলো যতক্ষণ থাকে) সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কমেছে শীতকালে।এর মধ্যে গত ৪০ বছরে রংপুর বিভাগে সূর্যালোক সবচেয়ে বেশি কমেছে।এরপর সূর্যালোক কমেছে ঢাকা,ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগে।

অন্যদিকে মেঘের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি হারে বেড়েছে রাজশাহী,রংপুর ও খুলনা বিভাগে।

গবেষণায় দেখা গেছে,শীতের সময় গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেও দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কমে গেছে।এটি সবচেয়ে কমেছে ঢাকা বিভাগে।এরপর আছে রংপুর,রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগ।গত ৪০ বছরের মধ্যে প্রতি দশকে ঢাকায় দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য গড়ে কমেছে শূন্য দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।ঢাকার পর দিনে ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমেছে রাজশাহী ও ময়মনসিংহে।এই দুই বিভাগে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য গড়ে কমেছে শূন্য দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।

দেশের বায়ুদূষণের পেছনে কমবেশি ৩০ শতাংশ কারণ হিসেবে ধরা হয় আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহকে।এই বায়ুপ্রবাহ ভারতের হরিয়ানা অঞ্চল থেকে এসে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে।দূষণের কারণে সূর্যালোকে বাধাগ্রস্ত হয়।

গবেষক বজলুর রশিদ মনে করেন,এই পার্থক্য সৃষ্টির পেছনের কারণ বায়ুদূষণ।দূষণের কারণে দিনের অনেকটা সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে।সূর্যালোক কম হয়।

দেশের বায়ুদূষণের পেছনে কমবেশি ৩০ শতাংশ কারণ হিসেবে ধরা হয় আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহকে।এই বায়ুপ্রবাহ ভারতের হরিয়ানা অঞ্চল থেকে এসে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে।দূষণের কারণে সূর্যালোকে বাধাগ্রস্ত হয়।

তাহলে ঢাকার চেয়ে রংপুরের দূষণ কম কেন,এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন,আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহের প্রবেশপথ রংপুর অঞ্চল হলেও সেখানে ঢাকার মতো স্থানীয় দূষণের উৎস নেই।ঢাকায় যানবাহন,কলকারখানা,নির্মাণকাজ এবং ইটভাটার মতো বড় উৎসগুলো আছে।এটাই ঢাকায় বায়ু দূষণ বেশি হওয়ার কারণ।

তাপপ্রবাহ ও শৈত্যপ্রবাহের হেরফের
গবেষণায় দেখা গেছে,ঢাকায় ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তাপপ্রবাহ শুরু হতো মার্চের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। তবে ১৯৯৭ সালের পর থেকে এতে ভিন্নতা দেখা গেছে। এখন দেখা গেছে,এটিও পিছিয়ে যাচ্ছে।এপ্রিল ও মে মাসজুড়েই তাপপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। এমনকি ২০১০ সালের পর থেকে বর্ষা মৌসুমেও তাপপ্রবাহ বেড়েছে।

উত্তর-পশ্চিমের জনপদ রাজশাহীতে দেখা গেছে,১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে বর্ষা মৌসুমে দুই থেকে তিনটি করে তাপপ্রবাহ বয়ে যেত।সেটি ২০১০ থেকে ২০২০ সালের দিকে ৮ থেকে ১২টি পর্যন্ত হয়ে গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে,রংপুর,খুলনাসহ প্রায় সব বিভাগে বর্ষা মৌসুমেও তাপপ্রবাহের সংখ্যা বেড়েছে।তবে চট্টগ্রামে তাপপ্রবাহের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম।

ঢাকায় বেশির ভাগ শৈত্যপ্রবাহ হতো জানুয়ারি মাসে।তবে গত শতকের ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে।ঢাকায় সার্বিকভাবে শৈত্যপ্রবাহ কমে গেছে।

রাজশাহীতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতো। ২০০৬ সালের পর এ প্রবণতা কমে গেছে। শীত আসছে দেরিতে। ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে শৈত্যপ্রবাহ কমলেও বেড়েছে জানুয়ারিতে।

বর্ষা আসার সময় পাল্টেছে
সাধারণত মে মাসের শেষের দিক থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে।আর তা চলে যেতে থাকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে।

গবেষণার তথ্য বলছে,২০০০ সালের পর থেকে কখনো কখনো বর্ষা আসতে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে। গত বছর বর্ষা এসেছে ৮ জুন।একইভাবে বর্ষা যাচ্ছেও দেরি করে।গত ১০ বছরে কখনো কখনো ২৩ অক্টোবর পর্যন্তও মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ছিল।অর্থাৎ তখনো বৃষ্টি হতো।

বাংলাদেশের কৃষি মূলত ধানভিত্তিক।আর স্বভাবতই এর সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নিবিড়।তবে বর্ষার আসা-যাওয়ার হেরফেরে কৃষির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক এ বি এম আরিফ হাসান খান।তিনি বলেন,বর্ষা দেরিতে আসায় এবং মেঘাচ্ছন্ন দিন বেশি হওয়ায় সালোক সংশ্লেষণ কম হয়।এতে আউশ ধানের উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। তাপপ্রবাহ বেশি থাকায় বোরো ধান পুষ্ট হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়।

আরও খবর

Sponsered content