আরো

কক্সবাজারে আঠারো হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রেলওয়ে পানিতে ডুবে গেছে!

  প্রতিনিধি ১৮ আগস্ট ২০২৩ , ৩:৫১:৩৭ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাবার আশায় অপেক্ষায় থাকা অনেকেই নতুন রেললাইনের ভগ্নদশা দেখে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এ মেগা প্রকল্প কতটা জলবায়ুর বান্ধব,টেকসই আর পরিকল্পিত হচ্ছে তা নিয়েও।

অগাস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়,রেললাইনটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়ার তেমুহনী এলাকায় আধা কিলোমিটার জুড়ে।ক্ষতিগ্রস্ত অংশে রেললাইন উঁচু-নিচু হয়ে আছে। স্লিপারের মাঝে পাথর সরে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। সংস্কার ছাড়া এ পথে রেল চলাচল শুরু করা একেবারেই অসম্ভব।

সামান্য ক্ষতি?
চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবার পথে নতুন রেললাইনের এ ক্ষতিকে নগন্য হিসেবে দেখছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।কর্তৃপক্ষের মতে,রেলপথের এই ক্ষতি মেরামতে দু’সপ্তাহ কাজ করতে হবে।প্রকল্প পরিচালকের দাবি করছেন পরিকল্পনা অনুযায়ী অক্টোবর মাসেই এর উদ্বোধন এবং ট্রেন চলাচল শুরু করা হবে।

“যে ক্ষতি হয়েছে এটা যদি আমাদের চালু কোনো রেললাইন হতো তাহলে আমরা একদিনে ঠিক করে ফেলতে পারতাম। আমার যে ক্ষতিটা হয়েছে এই ক্ষতির পরিমাণ তো খুব বেশি না।নগন্য এ ক্ষতির পরিমাণ।”আমার পুরো প্রজেক্টের যে ব্যয় ওই তুলনায় ক্ষতি তো এক-দেড় কোটি টাকা।এটা সামান্য। একটা নরমাল মেইনটেনেন্সে আমাদের লাগে।এ ধরনের ক্ষতি আমাদের যেগুলো চলমান রেলওয়ে আছে এগুলোতেও বন্যা হলে হয়,” বলেন প্রকল্প পরিচালক।

রেললাইনের ক্ষতিকে সামান্য দাবি করা হলেও এটিকে মোটেও খাটো করে দেখতে চান না বিশেষজ্ঞরা।এবারের অভিজ্ঞতা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনটি সংস্কার বা মেরামতের স্থায়ী সমাধানে নজর দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

ড. আইনুন নিশাত বলেন,যেটা ঘটে গেছে সেটা কেন ঘটেছে সেটা হিসাব-নিকাশ করা হোক।জাতীয় কমিটি হওয়া উচিত একটা।”আমাদের দেশের কালচার হচ্ছে ভেঙেছে ওইটাকেই আবার পুনর্নির্মাণ করা।কেন ভেঙ্গেছে এই কারণটা খুঁজে বের করে ভবিষ্যতে যাতে এই ভুলের মধ্যে না পড়ি সেটা ঠিক করতে হবে।”

এখন কীভাবে সমস্যার সমাধান হবে এ প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “সমাধান তো অনেকগুলোই আছে।কিন্তু এর আগে তো এখানে এ রকম বৃষ্টিপাত হয়নি।বিশেষজ্ঞরা যে মতামত দেয় সে মতামত আমরা সাদরে গ্রহণ করবো।”

চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেললাইনের দৈর্ঘ্য ১০২ কিলোমিটার।এ প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে আঠারো হাজার কোটি টাকারও বেশি।এ অবকাঠামো বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প।

আগামী অক্টোবর মাসে উদ্বোধনের পর রেল চলাচল শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।নির্মাণ শেষ হবার আগেই পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পূর্ব নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে কী না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

রেললাইন কেন ক্ষতিগ্রস্ত?
স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন,নতুন এই রেললাইনে যে বাঁধ দেয়া হয়েছে সেখান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়নি।রেললাইনের সাথে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন,সেখানে আরো বেশি কালভার্ট রাখার প্রয়োজন ছিল।যেগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো আরো প্রশস্ত করে বানানোর প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় একজন কৃষক আবুল কালাম রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরাল সড়ক বিভাগের রাস্তা দেখিয়ে বলেন,একই দূরত্বে সড়কের চেয়ে রেললাইনে কম কালভার্ট দেয়া হয়েছে।যেগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলোর রাস্তার চেয়ে কম প্রশস্ত।রাস্তার যে দূরত্বে চারটি বড় কালভার্ট দেখা যায়,তার বিপরীতে একই দূরত্বে রেলপথে দুটি কালভার্ট চোখে পড়ে।

এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নকশা ও পরিকল্পনায় স্থানীয় জনসাধারণের অভিজ্ঞতা ও মতামতকে যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি।এমনটাই মনে করেন নাগরিক সংগঠন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি এবং প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন প্রকল্পে ডিজাইনের সময় স্থানীয় জনসাধারণের মতামত নেয়া খুবই জরুরি।

“স্থানীয়রা যারা বলছে যে এখানে কালভার্ট কম হয়েছে, ওপেনিং কম হয়েছে সেটা নিয়ে তাদের সঙ্গে বসা দরকার ছিল।এখানে পিপলস পার্টিসিপেশন ছাড়া কিন্তু প্রজেক্ট ডিজাইন করা সম্ভব না।এইটাই আমাদের একটা বড় গলদ”।আমরা মনে করি আপনি ইঞ্জিনিয়ার না,আপনার সাথে কী আলাপ করবো? নো।আপনি প্রত্যেকদিন ওই যায়গা দিয়ে হাটছেন।কোথায় কী প্রবলেম সেটা আমার থেকে বেশি যানেন। ওরাতো আর আর আমাদের এখানে থাকে না।

তবে কালভার্টের সংখ্যা কমানো হয়নি বরং বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান।তিনি জানান কক্সবাজার রেল লাইনের একশ কিলোমিটারে ১৭৩টি কালভার্ট,৩৮টি ব্রিজ তৈরি হয়েছে।একশ কিলোমিটার রেল লাইনে সাড়ে চার কিলোমিটার জায়গা পানি নিষ্কাশনের জন্য ওপেন রাখা হয়েছে।রেললাইনের ক্ষতির কারণ হিসেবে রেকর্ড বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলকেই দায়ী করছেন।

প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, “ দু’দিনে আটশো মিলিমিটার বৃষ্টি তো আগে কখনো হয়নি।এখন যদি আমাদের ক্লাইমেটের অদ্ভুত আচরণের জন্য হয়,এই জিনিসগুলোতো আমাদের আগে জানা ছিল না।এভাবে তো আমরা কালভার্টের সংখ্যা করিনি। আরো দুটো কালভার্ট যদি থাকতো তাহলে কি বন্যা হতো না?।”“রোড থেকে আমাদের রেললাইন অনেক উপরে।রোড তো পুরোটাই ডুবে গিয়েছিল। পুরো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।সেই তুলনায় আমার তো মাত্র ৪৫০ মিটার বা আধা কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
রেল কর্তৃপক্ষ ক্ষতির জন্য কেবল অতিবৃষ্টিকে দায়ী করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন,এই ধরনের বৃষ্টিপাত এখন থেকে এখন আর অস্বাভাবিক নয়।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টির ঘটনা বাড়বে।”তাহলে এই যে রেললাইনটা বানানো হয়েছে,যেটা উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত আর পানির ঢল নেমে পূব থেকে পশ্চিম দিকে আসে সাগরে যাবে।এটা ডিজাইন করার সময় এই ফ্যাক্টরটা কনসিডার করার প্রয়োজন ছিল,।রেললাইন প্রকল্প পরিকল্পনার সময় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি।কম সময়ে অধিক বৃষ্টিপাতের বিষয়টি নজরে রাখা হয়নি।এজন্য অনেকের দায় আছে।“পানি নিষ্কাশনের যায়গাটা তারা ঠিকমতো রাখেনি। যিনি ফিজিবিলিটি করেছেন তিনি রাখেননি,যিনি ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন তিনি রাখেননি।যিনি অ্যাপ্রুভ করেছেন তিনি দেখেনি!

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন,আন্তর্জাতিক পরামর্শকরা বিগত একশ বছরের বন্যা,জলোচ্ছ্বাস ও বৃষ্টির হিসেব করেই এ প্রকল্পের ডিজাইন করেছে।কিন্তু এবার সব রেকর্ড ভেঙ্গে দুই দিনে এক মাসের সমপরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে।

রেললাইনের ক্ষতি এবং বন্যা ও জলাবদ্ধতার ক্ষয়ক্ষতির কারণে ড. নিশাত ক্ষোভ জানিয়ে বলেন,প্রচুর ওপেনিং রাখার দরকার ছিল যাতে করে পানি বেরিয়ে যেতে পারে। এটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফেইলিওর।আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার,আমি খুবই লজ্জিত।হাইড্রোলিজক ফেইলিওর, আমি হাইড্রোলজি পড়িয়েছি আমি খুবই লজ্জিত,পিওর ফেইলিওর।”

আরও খবর

Sponsered content