সারাদেশ

মেহেন্দিগঞ্জে মেঘনাসহ ৭টি নদীর তীব্র ভাঙ্গনে গোটা উপজেলায় আতংক বিরাজ করছে

  প্রতিনিধি ১১ অক্টোবর ২০২৩ , ১:১৪:২৮ প্রিন্ট সংস্করণ

মেহেন্দিগঞ্জ (বরিশাল) প্রতিনিধি।।বরিশাল জেলা সদর থকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পূর্ব- উত্তর দিকে অবস্থিত এবং সর্বোধিক নদী পরিবেষ্ঠিত একটি উপজেলা মেহেন্দিগঞ্জ।
মেহেন্দিগঞ্জে মেঘনাসহ ৭টি নদীর তীব্র ভাঙ্গনে গোটা উপজেলায় আতংক বিরাজ করছে। নদীর তীরবর্তী হাজারো পরিবারে নির্ঘুম রাত কাটছে।

ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে নদীর তীর ঘেঁষা বাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং আশপাশের গ্রাম ও বসতভিটা। সীমিত হয়ে আসছে উপজেলার মানচিত্র। চলতি বর্ষায় ৭টি নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে ৮টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় হাজার বসতভিটা, ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শত শত একর ফসলি জমি, পাকা রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয়রা জানান, মেঘনা, কালা বদর, গজারিয়া, তেতুলিয়া, মাস কাটা, ইলিশা ও লতা নদীর তীব্র ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে ৫ নং মেহেন্দিগঞ্জ ইউনিয়ন, উলানিয়া, গোবিন্দপুর, দড়িচর খাজুরিয়া, জয়নগর, ভাষানচর, জাঙ্গালিয়া, চরগোপালপুর,আলীমাবাদ ও শ্রীপুর ইউনিয়ন। এখানকার মানুষের বড় দুর্যোগ নদী ভাঙ্গন। প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেয়ালের কারণে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে বিপন্ন।

মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ৮টি নদী দ্বারা বেষ্টিত। ভাঙনের শিকার অনেক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে বেড়িবাঁধে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছে।জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির হোসেন হাওলাদার বলেন, গজারিয়া নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে তার ইউনিয়নের ৫টি ওয়ার্ড নদীতে বিলীন হতে চলছে। বিলীন হয়েছে ৩শতাধিক বসতভিটা, ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হুমকির মুখে চরহাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চুনারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাদের আলী স্মৃতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রহমানেরহাট বাজার। রহমানেরহাট লঞ্চঘাট এলাকায় সরকারি বরাদ্দে এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যায়ে ভাঙ্গনরোধে জিওব্যাগ ফেলা হলেও তা ৬মাসের মাথায় বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় ৪-৫ কোটি টাকার পাকা রাস্তা বিলীন হয়েছে বলে দাবি করেন।

চরগোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুল বারী মনির জানান, তেতুলিয়া নদীতে তার ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ড সম্পুর্ন বিলীন হয়ে গেছে, ২টি ওয়ার্ডের ৭০পার্সেন্ট বিলীন হয়ে গেছে। ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩কিলো পাকা রাস্তা, ২শতাধিক বসতভিটা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র দ্বিতল ভবন নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে লেঙ্গুটিয়া মুসলিম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও লেঙ্গুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নদী ভাঙ্গন রোধে ৬০০ ফিট জিওব্যাগ ফালানো হয়। ৬মাস পর আবার সেখানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এক কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যায়ে বিদ্যালয় ঠেকানোর জন্য জিওব্যাগ ফালানো হচ্ছে। ব্লোক দিয়ে বাঁধ তৈরি করা না হলে ভাঙ্গন ঠেকানো যাবে না বলে জানান তিনি ।

চানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাহা উদ্দীন ঢালী বলেন, তেতুলিয়া ও ইলিশা নদীতে তার ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ড সুকনাকাঠি, চানপুর, চরখাগকাটা নদীতে বিলীন। অর্ধশতাধিক বসতভিটা ও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীতে বিলীন। চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খন্তাখালী পুরাতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুকনাকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হুমকির মুখে। কোটি টাকার পাকা ও হেরিং বন রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে।

শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ মোল্লা বলেন কালাবদর ও তেতুলিয়া নদীতে সম্পুর্ণ বিলীন তার ইউনিয়নের ১- ২,৪ ,৭ ও ৯ নং ওয়ার্ড। চরবগী স্কুল কাম সাইক্লোন সেন্টার, বাহেরচর শ্রীপুর স্কুল কাম সাইক্লোন সেন্টার, শ্রীপুর মহিষা স্কুল কাম সাইক্লোন সেন্টার ও চরবগি দাখিল মাদরাসা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে মহিষা ওয়াহেদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও চরফেনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়াও ২-৩ কোটি টাকার পুল ব্রিজ কালবাট পাকারাস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

আলীমাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন ইমরান হোসেন বাপ্পি বলেন, তার ইউনিয়নের চরমহিষা ও মিঠুয়া ওয়ার্ড মেঘনা ও মাসকাটা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গনরোধে কেউ উদ্যােগ নেয়নি। আমি ভাঙ্গনরোধে দ্রুত উদ্যােগ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

উপজেলার ৫নং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, তার ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডের ৫০পার্সেন্ট নদীতে বিলীন, অর্ধশতাধিক বসতভিটা, ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি মাদরাসা বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গনকোলে রয়েছে কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত ৩লা বিশিষ্ট সাদেকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন। এছাড়াও ভাঙ্গন কবলিত গ্রামটি উপজেলা হেডকোয়ার্টার নিকটবর্তী। বিলীন হয়েছে কোটি টাকার ব্যায়ে তৈরি করা পাকা ও হেরিংবন রাস্তা।

উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জামাল মোল্লা বলেন, তার ইউনিয়নে ৩৮৬ কোটি টাকা ব্যায়ে মেঘনার তীর সংরক্ষণ বাধ নির্মান করা হলেও কাজ শেষ হতে না হতে বাঁধ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একাধিক জায়গায় বাঁধ তলিয়ে ঘোল পড়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে একুশে রচয়িতা কালজয়ী সাংবাদিক বিশিষ্ট কলামিস্ট প্রয়াত আব্দুল গাফফার চৌধুরী ও সদ্য প্রয়াত কবি আসাদ চৌধুরীদের জন্মস্থান উলানিয়া জমিদার বাড়ি, ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঐতিহ্যবাহী পুরাতন উলানিয়া বাজার, ২টি ব্যাংক,জমিদারদের নান্দনিক স্থাপনাগুলো। যে ২টি জায়গায় বাঁধ তলিয়ে ঘোল পড়েছে, তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যােগে জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। ভাঙ্গন এলাকায় নতুন করে বাঁধ নির্মান না হলে মহাবিপদ দেখা দিবে। বাধ নির্মান করার দাবি জানান।
স্থানীয়রা বলেন, মেঘনার তীর সংরক্ষণ বাধ নির্মানে অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি।

দড়িরচর খাজুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা রাঢ়ী বলেন,আমাদের এলাকায় নদী ভাঙ্গনের খবর কেউ রাখেন না,এমনকি খোঁজখবরও নেননি। তিনি জানান গজারিয়া নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে তার ইউনিয়নের ৯, ৫ ও ২ নং ওয়ার্ড সম্পুর্ন বিলীন হয়ে গেছে।৪টি ওয়ার্ডের ৬০ পার্সেন্ট বিলীন হয়েছে।প্রায় ৫শতাধিক বসতভিটা বিলীন হয়েছে। ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিলীন হয়ে গেছে।

এব্যাপারে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ কাজী আনিসুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন,স্হানীয় সংসদ সদস্য পংকজ নাথ,পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী (অবঃ) কর্নেল জাহিদ ফারুক শামীম এমপি সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নদীর ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।এসব নদীর ভাঙ্গন রোধে জরুরি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নদীর ভাঙ্গন রোধে সি-ব্লক ও রাবার বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী (অবঃ)কর্নেল জাহিদ ফারুক শামীম এমপি সাংবাদিকদের বলেন, সারাদেশে নদীর ভাঙ্গন রোধে সি-ব্লক ও রাবার বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন নদী ভাঙ্গন রোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকে অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে জরুরি বরাদ্দ দিয়েছে।

আরও খবর

Sponsered content