জাতীয়

যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আমাকে ক্ষমতায় চায় না বলেই র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে!

  প্রতিনিধি ১৬ মে ২০২৩ , ৪:৪১:৫২ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় চায় না বলেই বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য সফরের সময় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিম। সাক্ষাৎকারের একটি অংশের ভিডিও তিনি টুইটারে শেয়ার করেছেন।

বিবিসি জানতে চেয়েছিল,যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যাবের ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন,“যে বাহিনীর ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে,সেটা তাদের পরামর্শেই ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।তাদের সকল প্রশিক্ষণ,সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে।যেভাবে তারা এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে,তারা সেভাবেই কাজ করছে বলে আমার বিশ্বাস।তাহলে কেন তারা এই নিষেধাজ্ঞা দিল?এটা আমার কাছেও বিরাট এক প্রশ্ন।”

ইয়ালদা হাকিম তখন জানতে চান,যুক্তরাষ্ট্র তাহলে কেন এটা করেছে বলে শেখ হাসিনা মনে করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না,হয়তো তারা আমার কাজ অব্যাহত থাকুক তা চায় না,আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি,সেটা তারা হয়ত গ্রহণ করতে পারছে না। এটা আমার অনুভূতি।”

In a rare interview with Bangladesh’s PM, Sheikh Hasina, I asked her about human right’s records in her country and concerns around extrajudicial killings, forced disappearances, torture and cracking down on the press. She denied the accusations #Bangladesh pic.twitter.com/qbfdudEX6A

— Yalda Hakim (@BBCYaldaHakim) May 15, 2023
গুরুতর’মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর এলিট ফোর্স র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

এরপর বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া মেলেনি।যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে আসছে,নিষেধাজ্ঞা উঠানোর প্রক্রিয়া বেশ ‘জটিল’।

শেখ হাসিনা সাক্ষাৎকারে বলেন,একটা সময় সন্ত্রাসবাদ সব দেশের জন্যই সমস্যা হয়ে উঠেছিল।বাংলাদেশে সরকার সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।এরপর মাত্র একটি ঘটনা (হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা) ঘটেছে।বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর ওই সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। তারা জানিয়েছে,প্রায় আধঘণ্টার সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ,বিচার বর্হিভূত হ্ত্যা,গণতন্ত্র এবং রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বলে যে অভিযোগ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে করা হয়,তা নাকচ করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, শুধুমাত্র গত ১৪ বছর ধরেই দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে,সে কারণেই বাংলাদেশ উন্নতি করতে পারছে।

‘তারা চায় না এই পরিবারের কেউ ক্ষমতায় আসুক’

বিবিসি বাংলা জানিয়েছে,সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিম মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির আগে বাংলাদেশে বন্দুকযুদ্ধের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।

তিনি বলেন,নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ২০১৮ সালে ৪৬৬ মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ২০১৯ সালে ৩৮৮ মানুষ এভাবে নিহত হয় আর ২০২০ সালে নিহত হয় ১৮৮ জন।কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর ওই সংখ্যা ১৫ জনে নেমে এসেছে।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন,যেসব সংখ্যা তারা উল্লেখ করেছে, সেগুলো তারা প্রমাণ করতে পারেনি।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব হত্যাকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেনি।কারণ আমরা প্রমাণ চেয়েছিলাম, সেগুলো তারা পাঠিয়ে দিক,আমরা তদন্ত করে দেখব।”

জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচেভেলের একটি তথ্যচিত্রে সম্প্রতি দাবি করা হয়।

দুজন ব্যক্তি গোপন তথ্য ফাঁস করে বলেছেন যে,এসব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসেছে। এ বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছে বিবিসি।

উত্তরে তিনি বলেন, “আমি জানি না তারা কীভাবে এটা করেছে,কিন্তু আমেরিকায় কী ঘটছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন। সেখানে প্রায় প্রতিদিন একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে।এমনকি স্কুল,শপিং মল,রেস্তোরাঁয় হত্যাকাণ্ড ঘটছে।এমনকি স্কুল শিক্ষার্থীরা,সাধারণ মানুষ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অথবা সশস্ত্র ব্যক্তির হাতে নিহত হচ্ছে।

“আমার মনে হয়,যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজেদের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়া।তাদের দেশের কী অবস্থা?তাদের উচিত শিশুদের জীবন রক্ষা করা।তারা নিজেদের লোকজনের ব্যাপারে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা যেসব অভিযোগ করেছে, আমরা তাদের কাছে প্রমাণ চেয়েছিলাম। তারা দেয়নি।”

শেখ হাসিনা বলেন,তার মনে হচ্ছে,এই নিষেধাজ্ঞা,পাল্টা নিষেধাজ্ঞা একটি ‘খেলার মত’। কেন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল,সেটা এখনও তার কাছে স্পষ্ট নয়।

নিজের পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এই খুনিরা দায়মুক্তি পেয়েছিল। আমি এমনকি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারিনি,আমার বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না।সেই সময় তারা কোন নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।বরং একজন হত্যাকারী আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছে।আমরা তাদের বারবার অনুরোধ করেছি,তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য।তারা করেনি।কেন তারা শুনছে না, আমি জানি না।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এপ্রিলে সংসদে এক বক্তব্যে বলেছিলেন,যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো দেশে ক্ষমতা “উল্টাতে পারে, পাল্টাতে পারে”।সে প্রসঙ্গেও সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করে বিবিসি।

জবাবে তিনি বলেন, ‘’আমার কাছে একটা বড় প্রশ্ন হল, কেন তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করল?যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য কাজ করছে,মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে,তখন তারা লঙ্ঘনকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে,যারা ভুক্তভোগী, তাদের পক্ষে নয়।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল,হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘ, সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে-বিবিসির সাংবাদিক এই প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন,“আমি জানি ১২টি প্রতিষ্ঠান মিলে এসব বক্তব্য দিয়েছে,কিন্তু তারা প্রমাণ করতে পারেনি।আমি জানি না কী আন্তর্জাতিক খেলা চলছে।”

“কেন তারা আপনাকে সরাতে চাইবে”– ইয়ালদা হাকিমের এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “তারা আমার পিতাকে হত্যা করেছে।যারা আমার পরিবারকে হত্যা করেছে,এমনকি ১০ বছরের ভাইকে হত্যা করেছে,সেই ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না এই পরিবারের কেউ ক্ষমতায় আসুক।”

‘আমার মানবাধিকার নিয়ে তারা কথা বলে না’

বিবিসি বাংলা জানিয়েছে,বাংলাদেশের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং সংবাদ মাধ্যমের ওপর চাপ তৈরির অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার উদ্বেগ প্রকাশের প্রসঙ্গ ধরে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ইয়ালদা হাকিম।

উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন,আমি জানি না,তারা যেসব অভিযোগ করছে,সেগুলো খুব বেশি প্রমাণ করতে পারেনি। কিছু গ্রুপ বড় বড় সংখ্যায় অভিযোগ করেছে,কিন্তু আমরা যখন তদন্ত করেছি,তখন আমরা পাঁচ ছয়জনের ব্যাপার দেখতে পেয়েছি।

“আসলে কিছু মানুষ বিভিন্ন কারণে নিজেরাই লুকিয়ে ছিল। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমরাও সমর্থন করি না।আমাদের দেশে আইন আছে,আমাদের আইন প্রয়োগকারীরা কোনো অন্যায় করলে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হয়। তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।”

বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২০ হাজারের মত মামলা, সাত হাজারের বেশি বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের তথ্যের প্রসঙ্গ ধরে বিবিসির প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন,“হ্যাঁ, কিন্তু তারা কী করেছিল?তারা মানুষ হত্যা করেছে,তারা মলোটভ ককটেল ছুড়েছে,তারা পাবলিক বাসে আগুন দিয়েছে।৩৮০০ পাবলিক বাসের ভেতরে যাত্রীদের রেখেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।তারা সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে,ট্রেন,লঞ্চ,প্রাইভেট কারে আগুন দিয়েছে।আপনি হলে কি করতেন?আপনারা কি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতেন না?

“এটা সাধারণ দলীয় সমর্থকদের ক্ষেত্রে করা হয়নি।যারা হত্যা করেছে,মানুষকে নির্যাতন করেছে,দুর্নীতি করেছে-এই জন্য তারা শাস্তি পেয়েছে। আমি বুঝতে পারি না,তারা যেসব অপরাধ করেছে,কেন এইসব (মানবাধিকার) সংগঠন সেটা দেখতে পাচ্ছে না।”

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন,“মানবাধিকার সংস্থাগুলো কখনো আমার মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেনি।যখন আমার পুরো পরিবারকে হারিয়েছে,তখনো তারা আমার পক্ষে কথা বলেনি। কেন?”

বাংলাদেশ ‘সবসময়ই মানবাধিকার রক্ষা করে আসছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন,মানবাধিকার মানে শুধু শরীরের নিরাপত্তা নয়।তার বিচারে,মানবাধিকার মানে হল নিরাপত্তার পাশাপাশি খাদ্য,শিক্ষা,ভোট,সুস্থ থাকার অধিকারও।আর এ সবকিছুই তার সরকার ‘রক্ষা করছে’।

‘মানুষ কেন ভোট দেবে না’

বিবিসি বাংলা লিখেছে,শেখ হাসিনা ‘নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চান’ বলে যে অভিযোগ বিরোধী দলগুলোর দিক থেকে করা হয়, সে বিষয়েও সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন,“অবশ্যই না।নির্বাচন এবং ভোটাধিকারের জন্য আমি সারাজীবন ধরে সংগ্রাম করেছি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে।নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য আমরাই আইন করেছি। আমরা সবসময়েই চেয়েছি যেন মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়।এখন আমাদের ভোটার লিস্ট ছবিসহ তৈরি করেছি, আমরা স্বচ্ছ ব্যালট বক্সের ব্যবস্থা করেছি।”

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৯৬ শতাংশ ভোট পাওয়ার বিষয়টিতে রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের ভোটের সঙ্গে তুলনা করেন বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিম।

শেখ হাসিনা জবাবে বলেন, “কেন নয়। আমাদের কাজের জন্যই মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে।আমরা তাদের জন্য কাজ করেছি।আমাদের ১৭০ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে।আমাদের জনগণ রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে সচেতন।আমরা ক্ষমতায় আসার পর দারিদ্র্য কমেছে,খাদ্য নিরাপত্তা বেড়েছে, শিক্ষা,স্বাস্থ্য,গৃহায়ন-সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। তাহলে মানুষ কেন (আমাদের) ভোট দেবে না?’’

২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,নির্বাচন অবশ্যই স্বচ্ছ এবং অবাধ হয়েছে।২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা (বিএনপি জোট) শুরুতে অংশ নিয়েছিল।কিন্তু পরিস্থিতি কী হল?আমাদের ৩০০ আসন আছে। আপনাকে তিনশ প্রার্থী দিতে হবে।তারা মনোনয়ন দিয়েছে প্রায় ৭০০ জনকে।তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা নির্বাচন থেকে সরে যায়।তাহলে তারা কীভাবে দাবি করতে পারে যে,নির্বাচন স্বচ্ছ,অবাধ হয়নি?”

আরও খবর

Sponsered content