ব্যবসা ও বাণিজ্য সংবাদ

৩১ কোটি ডলারের সুট ও ব্লেজার রপ্তানি হয়েছে

  প্রতিনিধি ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ , ১২:৪৭:২১ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।অনেক বছর ধরেই সাধারণ ভোক্তার উপযোগী মৌলিক পোশাক রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চমূল্যের ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক উৎপাদন ও সরবরাহকারী দেশের তালিকাতেও যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। টি-শার্ট,পোলো শার্ট,ট্রাউজার,ফরমাল শার্টের মতো গতানুগতিক পোশাকের পাশাপাশি হাল ফ্যাশনের সুট ও ব্লেজারও রপ্তানি হচ্ছে এখন।১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ ডলারের সুট ও ব্লেজারও রপ্তানি হচ্ছে।তবে কাপড়, রং, সেলাই ও ফিনিশিংয়ে নিখুঁত উচ্চমূল্যের সুট ও ব্লেজার এখনও রপ্তানির মূল প্রবাহে সেভাবে যুক্ত হয়নি।তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানি আয়ে পণ্যটির অবদান এক শতাংশের মতো।১৩টি প্রতিষ্ঠান সুট ও ব্লেজার উৎপাদন ও রপ্তানি করে থাকে।এখনও চীন, জাপান ও তুরস্কের দখলেই রয়েছে সুট ও ব্লেজারের বাজারের বড় অংশ।

সাধারণ পোশাকের চেয়ে দ্বিগুণ রপ্তানি:সুট ও ব্লেজারের বিশ্ববাজার এখন ১৬০ বিলিয়ন ডলারের।এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশ এক বিলিয়ন ডলারেরও কম।এখনও সুট ও ব্লেজারের বিশ্ববাজারের মূল প্রবাহে যুক্ত হতে না পারলেও বাংলাদেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে এর রপ্তানি।চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে অর্থাৎ প্রথম ছয় মাসে পোশাক খাতের সব পণ্যে গড়ে যে হারে বেড়েছে,সুট ও ব্লেজারের রপ্তানি বেড়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে।ওই সময়ে ৩১ কোটি ডলারের সুট ও ব্লেজার রপ্তানি হয়েছে।গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২১ কোটি ডলার।অর্থাৎ রপ্তানি বেড়েছে ৩২ শতাংশ।এ সময় পোশাকপণ্যের সার্বিক রপ্তানি বেড়েছে ১৬ শতাংশের কম।গত অর্থবছরে সুট ও ব্লেজারে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ডলার।তার আগের অর্থবছর হয় ৩৬ কোটি ডলারের মতো। অর্থাৎ এক অর্থবছরে বেড়েছে ১০ কোটি ডলার।

উদ্যোক্তা অনেকে বলছেন,সম্ভাবনা অনুযায়ী এই প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়।পোশাকপণ্যে বৈচিত্র্য আনার কথা সরকার ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে।সুট ও ব্লেজারের রপ্তানি আরও বেশি হারে বাড়ছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে উদ্যোক্তারা প্রযুক্তি সক্ষমতার অভাবকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।তাঁরা বলেছেন,বিশেষ ধরনের মোল্ড বা ছাঁচে ব্লেজার উৎপাদন করতে হয়।এ ধরনের প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ টেকনিশিয়ান ও শ্রমিক প্রয়োজন।বাংলাদেশে এর ঘাটতি আছে। চীনা প্রযুক্তি ও টেকনিশিয়ানের সহায়তায় চলছে কয়েকটি কারখানা।ভালো ফিনিশিংয়ের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহও থাকতে হয়।সাধারণ পোশাকের কারখানার তুলনায় সুট ও ব্লেজার তৈরির কারখানায় অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন করে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য অনেক উদ্যোক্তার নেই।তবে ভিন্নমতও রয়েছে কোনো কোনো উদ্যোক্তার।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন,শুরুর দিকে সুট ও ব্লেজারের যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল বাস্তবে ততটা আশাপ্রদ নয় ব্যাপারটা।কারণ ফ্যাশন বিশ্বে এখন কেতাদুরস্ত ফরমাল পোশাকের চাহিদা কমছে। ভোক্তারা এখন যে পোশাকে হাঁটতে বের হন,সে পোশাকেই অফিস করতে চান।সাধারণ পার্টিও চলে এ ধরনের পোশাকে। এ কারণে এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। এসব পণ্য বরং কতটা ফ্যাশনদুরস্ত এবং মূল্য সংযোজিত হতে পারে সে দিকে মনোযোগ বেশি।বিশেষ করে কৃত্রিম তন্তুর টি-শার্ট, পলো শার্ট, জ্যাকেটের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী। পোশাকের বিশ্ববাজারের ৭৫ শতাংশই এখন এ ধরনের কৃত্রিম তন্তুর পোশাকের দখলে।বিশেষ করে অতিমারি করোনায় ফরমাল পোশাকের প্রয়োজন হয়নি।ঘরবন্দি মানুষকে ক্যাজুয়াল পোশাকই পরতে হয়েছে।এ কারণে তিন বছর ধরে ওভেনের চেয়ে নিটের রপ্তানি বেশি হচ্ছে।২০২২ সালে ওভেনের চেয়ে নিটের রপ্তানি বেশি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার।২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ওভেনের চেয়ে নিটের রপ্তানি বেড়ে যায়।

সুট ও ব্লেজারের ১০ ধরন :সুট আর ব্লেজারের মধ্যে চোখের দেখায় আপাতত কোনো পার্থক্য মনে হয় না।তবে এই দুইয়ের মাঝে বড় পার্থক্য আছে।সাধারণত কোট,ওয়েস্টকোট ও প্যান্ট মিলে একটি সম্পূর্ণ সুট হয়।সুট মানে কোটের সঙ্গে একই রং ও কাপড়ের প্যান্ট।ব্লেজারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। ডেনিম,গ্যাবার্ডিন কিংবা যে কোনো কাপড়ের প্যান্টের সঙ্গেই ব্লেজার মানিয়ে নেওয়া যায়।এমনকি হাইনেক গেঞ্জিও চালিয়ে দেওয়া যায়।ব্লেজার সংখ্যায় এক পিসই।ব্লেজারের ফেব্রিক্স তুলনামূলক মোটা হয়ে থাকে।রপ্তানির পাশাপাশি সুট আর ব্লেজারে দেশি বাজারও বাড়ছে।রাজধানীর অভিজাত শপিংমলে জারা-জেসিপেনির সুট ও ব্লেজারও পাওয়া যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে।আবার স্থানীয় বাজারের জন্য দেশে তৈরি পণ্যও বিক্রি হচ্ছে।যেমন- ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় কম দামের সুট ও ব্লেজার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও শতভাগ রপ্তানিমুখী ব্লেজারের সঙ্গে এসব সুট ও ব্লেজারের মানগত তফাত অনেক।প্রস্তুত বা রেডিমেইড সুট ও ব্লেজার ছাড়াও অভিজাত টেইলারিং শপেও এগুলো তৈরি হচ্ছে বেশ।বর্তমানে ১০ ধরনের সুট ও ব্লেজার রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় বয়েজ সুট ও স্পোর্টস আউটফিট।এ ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় আসে সিনথেটিক ফাইবারের ম্যানস সুট বা বড়দের সুট রপ্তানি থেকে।তৃতীয় সর্বোচ্চ আয় আসে নারীর স্যুট থেকে। এ ছাড়া পশুর পশম,উল,কটন ও নিটের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সুট ও ব্লেজার রপ্তানি হয়ে থাকে।

রপ্তানি পণ্যের দামদর:১১ বছর আগে জার্মানির বাজারের মাধ্যমে সুট রপ্তানি শুরু করে এনার্জি প্যাক ফ্যাশনস।ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য,চীন ও ভারতেও যায় তাদের সুট ও ব্লেজার। মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারসহ অনেক বড় ব্র্যান্ডই এসব বাজারে এনার্জি প্যাকের সুট ও ব্লেজার বাজারজাত করে থাকে।গত বছর এসব পণ্য লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০০ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন ১৪৯ থেকে ৪৯৯ ডলার দামের সুট ও ব্লেজার এতদিন রপ্তানি হয়েছে।এনার্জিপ্যাক ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ বলেন,এখন ৮০০ ডলারে প্রতি পিস সুট রপ্তানির জন্য একটি ব্র্যান্ডের সঙ্গে কথা প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে।সেলিব্রেটি এবং খেলোয়াড়রা এ ধরনের ব্লেজার পরে থাকেন।

তিনি বলেন,একটি সাধারণ টি-শার্ট মাত্র দুই থেকে তিন ডলারে বিক্রি হয়।এই বাস্তবতার মধ্যেও বাংলাদেশের প্রচার-প্রচারণা এখনও বলতে গেলে টি-শার্টকেন্দ্রিক নিট খাতকে কেন্দ্র করেই চলছে।এ কারণে অনেক ক্রেতা ব্র্যান্ড এখনও জানেই না,বাংলাদেশ সুট ও ব্লেজার উৎপাদন করছে।এই দুর্বল বিপণন কৌশলই সুট ও ব্লেজার রপ্তানিতে অনেক বড় দুর্বলতা।অথচ রপ্তানি বাড়াতে হলে এ ধরনের দামি পণ্যের দিকে যেতে হবে।করোনায় কমলেও এখন আবার সুট ও ব্লেজারের মতো দামি পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।তবে করোনার শিক্ষা হচ্ছে,বাজারে বৈচিত্র্য আনতেই হবে।ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোতেও মনোযোগ বাড়াতে হবে।এ ক্ষেত্রে চীন, জাপান,ভারত সম্ভাবনাময় বড় বাজার।

হুমায়ুন রশিদের মতে,সুট ও ব্লেজার উৎপাদনে বিনিয়োগে ঝুঁকিটাও একটু বেশি।কারণ,বিশেষায়িত এই পোশাকের কারখানায় অন্য কিছু উৎপাদন সম্ভব নয়।কোনো কারণে রপ্তানি আদেশ না থাকলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।সাধারণ কারখানার তুলনায় দ্বিগুণ বিনিয়োগে সুট ও ব্লেজারের কারখানা করতে হয়।এত টাকা বিনিয়োগের পর রপ্তানি আদেশ না থাকলে অবস্থা কী হবে,সে ভাবনা থেকে এখনও অনেকে বিনিয়োগে আসছেন না।সরকার উচ্চমূল্যের এই পণ্যে বিশেষ প্রণোদনা দিলে পোশাকের রপ্তানি আয় কম সময়ে দ্বিগুণে পৌঁছবে বলে মনে করেন তিনি।

আরও মনোযোগ প্রয়োজন:নির্দিষ্ট কিছু রপ্তানি পণ্যের ওপর বেশি নির্ভরতায় ঝুঁকিও বেশি থাকে।বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীরা এ নিয়ে বাংলাদেশকে অনেক দিন ধরে সতর্ক করে আসছে।সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাংলাদেশ ডেলিগেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়,পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকায় জোটের ২৮ দেশে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ।এ ক্ষেত্রে সুট ও ব্লেজারে এগিয়ে যাওয়ার বড় সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

অ্যাডাম অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল হক মুকুল বলেন,স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের পর পণ্য রপ্তানিতে এখনকার মতো শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না।তখন বাজার ধরা কঠিন হবে।হাতে এখন যে কয় বছর সময় আছে,তার মধ্যেই অপ্রচলিত পণ্য ভোক্তা চাহিদায় যুক্ত করতে হবে।কারণ এখনই কাজটা তুলনামূলক সহজ। দামি পণ্য হিসেবে সুট,ব্লেজারসহ আরও যত পণ্য রয়েছে, সেগুলো উৎপাদন ও রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগানো যায়।

আরও খবর

Sponsered content