অপরাধ-আইন-আদালত

লেডী কিলার রহিমা অঢেল সম্পদের মালিক!!!

  প্রতিনিধি ২৮ জুন ২০২২ , ১১:৩৮:৩৫ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:-এক যুগ ধরে রহিমা বেগমকে চেনেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মাহমুদনগরের স্থায়ী বাসিন্দা অলিউল্লাহ (৬৫)। তাঁরই চোখের সামনে ১০ বছর আগে মাহমুদনগরে সাততলা বাড়ি বানান রহিমা। অলিউল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মাহমুদনগরে রহিমার বাড়িটিই প্রথম সাততলা ভবন। তবে রহিমার আয়ের উৎস কী, সেটি তখন জানতাম না। পরে শুনেছি ঢাকায় রহিমা বেগম নাকি মাদকের ব্যবসা করে অল্প সময়ে অনেক পয়সার মালিক বনে গেছেন।’

মাহমুদনগরে রহিমার বাড়ির দেখভাল করেন নিহার বেগম নামের এক নারী। ২০ জুন নিহার মুঠোফোনে বললেন, ‘রহিমা আপা এক বছর আগে এই বাড়িতে এসেছিলেন। আর তিনি আসেন না। তবে লোক পাঠিয়ে ভাড়ার টাকা নিয়ে যান। শুনছি রহিমা আপার নামে মামলা-মোকদ্দমা আছে। রহিমা আপা কোথায় থাকেন, জানি না।’

রহিমা বেগম খুনের মামলার অভিযুক্ত আসামি। এ মামলায় জামিন নিয়ে পাঁচ বছর ধরে লাপাত্তা তিনি। তাঁর নামে ঢাকায় মাদকের এক ডজনের বেশি মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। চার মাস আগে রহিমা বেগমের ব্যাংক হিসাবে ১২ কোটি টাকা জমা থাকার তথ্য পেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর বাইরে রহিমার স্বামী ও তাঁর স্বজনদের ব্যাংক হিসাবে মিলেছে আরও ৯ কোটি টাকা। সাততলা বাড়ি ছাড়া রহিমার নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আরও কয়েক কাঠা জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় রহিমার বিরুদ্ধে গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওয়ারী থানায় অর্থ পাচার আইনে মামলা হয়েছে।

‘মাদক ব্যবসা করে রহিমা বেগম ও তাঁর স্বামীর অপরাধলব্ধ আয় নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করি। সেই অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক ব্যবসা করেই তাঁরা বাড়ি, জমিসহ স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন।’
আলী আসলাম হোসেন, মামলার বাদী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নারায়ণগঞ্জের
মামলার বাদী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আলী আসলাম হোসেন বলেন, ‘মাদক ব্যবসা করে রহিমা বেগম ও তাঁর স্বামীর অপরাধলব্ধ আয় নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করি। সেই অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক ব্যবসা করেই তাঁরা বাড়ি, জমিসহ স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন।’

তবে মামলা দায়েরের চার মাস পার হলেও রহিমার খোঁজ মিলছে না বলে জানালেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. বাহাউদ্দিন। তিনি বলেন, রহিমা ও তাঁর স্বজনদের ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা ২১ কোটি টাকা, সাততলা বাড়ি, জমিসহ সম্পদ যাতে স্থানান্তর বা রূপান্তর না হয়, সে জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করা হবে। তিনি বলেন, ‘রহিমা কোথায় আছেন, সেই খোঁজ কেউ দিতে পারছেন না।’

অবশ্য খুনসহ অন্য মামলায় রহিমার পক্ষ থেকে আদালতের কাছে লিখিতভাবে দাবি করা হয়েছে, রহিমা নিরপরাধ। হয়রানির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।

কোটিপতি রহিমা–হযরত দম্পতি

রহিমার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তবে তিনি বেড়ে ওঠেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ১১৫/৮ ডিস্টিলারি রোডে। ৪০ বছর ধরে রহিমাকে চেনেন গেন্ডারিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। ২০ জুন আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বহু বছর ধরে রহিমাকে চিনি। এই রহিমা নামাপাড়া বস্তিতে মাদক ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে তিনি থাকতেন, তাঁর স্বজনেরাও থাকতেন। পরে বিয়ে করেন হযরত আলীকে। এরপর গত ১০ বছরের ব্যবধানে কোটিপতি বনে যান তাঁরা। তবে হযরত আলী ২০১৯ সালে “ক্রসফায়ার”–এ নিহত হয়েছেন।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলার তথ্য বলছে, রহিমা বেগমের তিনটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। ১৪ বছর আগে (২০০৮ সাল) দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। আরেকটি হিসাব খোলা হয় ২০১৭ সালে। এই তিন ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হয় ১২ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

এ ছাড়া রহিমার স্বামী হযরতের নামে দুটি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। ১০ বছর আগে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। অন্যটি খোলা হয় চার বছর আগে। এই তিন ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া রহিমা–হযরত দম্পতির দুই ছেলের ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ৭ লাখ টাকা জমার তথ্য মিলেছে।

রহিমা ও তাঁর স্বামী হযরত তালিকাভুক্ত আসামি। রহিমা মূলত গেন্ডারিয়া এলাকায় মাদক ব্যবসা করতেন। হযরত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

মাজহারুল ইসলাম, যাত্রাবাড়ী থানার ওসি
অর্থ পাচার মামলার তথ্য বলছে, মাদক ব্যবসা করে তাঁরা এই সম্পদের মালিক হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের বাড়ি রহিমার নামে। সবুজবাগের মেরাদিয়া মৌজায় রহিমার সাড়ে তিন কাঠা জমি রয়েছে। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে রহিমার নামে আরও জমি রয়েছে।

মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, রহিমার বিরুদ্ধে গেন্ডারিয়া থানায় আটটি মাদকের মামলা রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থানায় তিনটি এবং রামপুরা থানায় একটি মাদকের মামলা রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলা করে পুলিশ। প্রতিটি মামলায় রহিমাকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। মামলাগুলো ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন।

এ ছাড়া রহিমার স্বামী হযরত আলীর বিরুদ্ধে গেন্ডারিয়া থানায় ছয়টি ও যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর ও ডেমরা থানায় একটি করে মাদকের মামলা রয়েছে।

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, রহিমা ও তাঁর স্বামী হযরত তালিকাভুক্ত আসামি। রহিমা মূলত গেন্ডারিয়া এলাকায় মাদক ব্যবসা করতেন। হযরত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

‘আমরাও মাদক ব্যবসায়ী রহিমাকে খুঁজছি। যেখানেই তাঁকে পাওয়া যাবে, গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে।’আবু সাঈদ আল মামুন, গেন্ডারিয়া থানার ওসি
খুনের প্রধান ‘অভিযুক্ত’ রহিমা।

আট বছর আগে (২০১৪ সালের ৮ নভেম্বর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আসলাম শিকদার নামের এক ব্যক্তি খুন হন। এই খুনের দায়ে রহিমাকে প্রধান আসামি করে ঢাকার আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। খুনের অন্য অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন রহিমার স্বামী হযরত আলীও।

মারা যাওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। অভিযোগপত্রে বলা হয়, রহিমা ও তাঁর স্বামী হযরত দুজনই মাদক ব্যবসায়ী। আর খুনের শিকার আসলাম ছিলেন একজন সোর্স। খুন হওয়ার আগে রহিমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আসলাম। এর জের ধরে আসলামকে খুন করা হয়। আসলামকে খুন করার জন্য ভাড়াটে খুনিদের রহিমা ছয় লাখ টাকা দেন।

আসলাম শিকদার খুনের মামলায় ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রহিমাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। রহিমা গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। তবে ২০২১ সাল থেকে তিনি পলাতক। রহিমার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।

গেন্ডারিয়া থানার ওসি আবু সাঈদ আল মামুন বলেন, ‘আমরাও মাদক ব্যবসায়ী রহিমাকে খুঁজছি। যেখানেই তাঁকে পাওয়া যাবে, গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে।’

আরও খবর

Sponsered content