ব্যবসা ও বাণিজ্য সংবাদ

ব্রিকস ১১ দেশের জোট

  প্রতিনিধি ২৭ আগস্ট ২০২৩ , ২:৪১:৪৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।জোহানেসবার্গ সম্মেলনের আগে ব্রিকসের সম্প্রসারণে অনিশ্চয়তা থাকলেও এই শীর্ষ বৈঠকেই পাঁচ জাতির এই জোট শেষ পর্যন্ত নতুন সদস্য বাছাইয়ের ব্যাপারে একমত হয়েছে। ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আগামী বছরে ব্রিকস জোটে যোগ দিতে। ফলে ব্রিকস হবে একটি ১১ দেশের জোট,যাদের থাকবে বিপুল জনসংখ্যা, দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি এবং জ্বালানি তেলের বিশাল ভান্ডার।

সব মিলিয়ে ৪০টিরও বেশি দেশ ব্রিকসের সদস্য হতে আবেদন বা আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।এসব দেশের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অর্থনীতি,যারা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশের তুলনায় ভালো অগ্রগতি অর্জন করেছে। আবেদনকারী অনেক দেশের সঙ্গে ব্রিকসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও রয়েছে।ঠিক কী যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন সদস্যদের বাছাই করা হয়েছে কিংবা কী কারণে কিছু আবেদনকারী বাদ পড়েছে,তা এখনো স্পষ্ট নয়।

স্বাগতিক দেশের প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা শুধু এটুকু বলেছেন,ব্রিকসের পাঁচটি সদস্যদেশ জোটের সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ার ‘পথনির্দেশক নীতি,মানদণ্ড,নির্ণায়ক ও পদ্ধতি’ সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল।

এরপরই সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরাত,ইরান, মিসর, ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনাকে ব্রিকসের নতুন সদস্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ঘোষণা করা হয়।

আগামী বছরের প্রথম দিনেই এই ছয় দেশ ব্রাজিল,রাশিয়া, ভারত,চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার এ জোটে যোগ দেবে বলে ঠিক করা হয়েছে। ২০০১ সালে ব্রিকসের ধারণা প্রথম প্রকাশ করা হলেও ২০০৯ সালে চারটি দেশের নেতারা প্রথমবারের মতো শীর্ষ সম্মেলনে বসেন এবং ২০১১ সালে জোট সম্প্রসারণ করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সদস্য করা হয়।

জোহানেসবার্গ সম্মেলনের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল জোটের সম্প্রসারণ। কিন্তু এর পদ্ধতি নির্দিষ্ট না থাকার কারণে নতুন সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি ছিল অনিশ্চিত। কোনো তরফ থেকে স্পষ্ট করে কিছু বলা না হলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছিল,সদস্য বাছাই করার নীতিমালা সম্পর্কে পাঁচ সদস্যদেশ একমত হতে পারছিল না। বিষয়টি আরও জটিল হয় ভারতের এক প্রস্তাবের পর।

জোটের সদস্য বাছাই

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রস্তাব ছিল,এমন কোনো দেশকে সদস্য করা হবে না,যে দেশ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে পারে এবং সদস্য বাছাই করতে হবে মাথাপিছু জিডিপির একটি ন্যূনতম মানদণ্ডের ভিত্তিতে।তবে তাঁর এই প্রস্তাব কতটা বিবেচনা করা হয়েছে,তা পরিষ্কার নয়,কারণ নতুন সদস্য হিসেবে ইথিওপিয়ার মতো দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যার মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশে চেয়েও কম।

‘ব্রিকসে আমন্ত্রণ জানানো ছয় দেশের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।মিল যদি কিছু থাকে,তা হলো তারা নিজের নিজের এলাকায় উল্লেখযোগ্য দেশ,’ আল-জাজিরাকে বলেছেন ড্যানি ব্র্যাডলো।তিনি ইউনিভার্সিটি অব প্রিটোরিয়ার সেন্টার ফর অ্যাডভান্সমেন্ট স্কলারশিপের একজন অধ্যাপক।

অন্যদিকে,ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল ডায়ালগের জ্যেষ্ঠ ফেলো সানুশা নাইডু বলেন,সৌদি আরব,ইরান,সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরকে জোটে নেওয়ার কারণে ‘আপনি বলতে পারেন এটি খুবই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক’ হয়ে পড়েছে।দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল ডায়ালগ মূলত চীন ও আফ্রিকা নিয়ে গবেষণা করে।

সানুশা নাইডু বলেন,এই সিদ্ধান্তের ভূ-অর্থনৈতিক,ভূকৌশল ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।তাঁর মতে,ব্রিকসের অনেক সদস্যদেশকে এখন তাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে ভাবতে হবে। আর চীন ও ভারতকে তাদের চলমান নীতিকে আরও জোরদার করতে হবে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে,এটা এখনো স্পষ্ট নয় যে ব্রিকসের সম্প্রসারণ বিশ্বমঞ্চে কীভাবে এই জোটের প্রভাব আরও বাড়াবে।সেটা করার জন্য তাদের এক হয়ে কার্যক্রম চালাতে হবে।তবে জোটে নতুন সদস্যরা একে আরও বেশি বিসদৃশ করে তুলেছে।এটি এখন কিছু শক্তিশালী একনায়কতন্ত্র এবং মধ্যম আয় ও উন্নয়নশীল গণতন্ত্রের জোট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আমেরিকা প্রোগ্রামের প্রধান রায়ান বার্গ মনে করেন,যেভাবে ব্রিকসের সম্প্রসারণ ঘটেছে,তা ‘চীন ও রাশিয়ার জন্য একটি বিজয়। তারা পাঁচ বছর ধরে এটা চাইছিল।চীনের চাওয়া, বেইজিং-কেন্দ্রিক একটি ব্যবস্থা এবং এটা তাদের তা চালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।আর অনেকটা বিচ্ছিন্ন রাশিয়ার জন্য এটা দারুণ এক সুযোগ।’

ব্রিকসের নতুন সদস্য আর্জেন্টিনা আর ইথিওপিয়া সংকটে জর্জরিত।আর্জেন্টিনার অর্থনীতি খুব খারাপ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে,আর ইথিওপিয়ার সংকট গৃহযুদ্ধকে ঘিরে।সৌদি আরব আবার ব্রিকসে যোগ দিচ্ছে ইরানকে সঙ্গে নিয়ে,যে দেশটি মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল তাদের ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’।

তবে চীনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের চিরায়ত দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় অতি সম্প্রতি সৌদি আরব ও ইরান সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।চীন যে ভূমিকা পালন করেছে, ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সেই ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়।অন্যদিকে,ভারত কিছুদিন আগে আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে,যার আওতায় দেশ দুটি রুপি ও দিরহামে বাণিজ্য করবে।

চীনের জয়

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসে সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের চীন ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষণাকেন্দ্রের মহাপরিচালক লিউ জংই লিখেছেন,জোহানেসবার্গ সম্মেলন চীনের জন্য একটি বিজয়, কারণ দেশটি ব্রিকসের সম্প্রসারণের জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করে আসছিল।

ভারত ব্রিকসের মতো জোটে বহুপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করছে—এমন অভিযোগ করে লিউ জংই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ ধরাতে ভারতকে ব্যবহার করছে।উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বেইজিংয়ের অবস্থান দুর্বল করতেও তারা দিল্লিকে ব্যবহার করছে।

চলতি বছর ভারতের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তারা এই ভূমিকা বেশ উপভোগও করছে—এমন মন্তব্য করে লিউ জংই বলেন,ব্রিকস সম্মেলনের সাফল্য এটা দেখাচ্ছে যে দক্ষিণের দেশ, অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলো চীনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।

লিউর মতে,জোহানেসবার্গের ব্রিকস সম্মেলন ভারতকে জেগে ওঠার জন্য একটি বার্তা পাঠাবে।

জ্বালানির শক্তি

ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল ডায়ালগের জ্যেষ্ঠ ফেলো সানুশা নাইডু মনে করেন,সম্প্রসারিত ব্রিকসের দিক তাকালে দেখা যায়, এটি ‘খুব বেশি জ্বালানিকেন্দ্রিক’।তিনি উল্লেখ করেন, নতুন সদস্যদেশের নাম ঘোষণার পর সম্মেলনস্থলেই অনেকে বলাবলি করছিল যে তারা একে এখন থেকে ‘ব্রিকস প্লাস ওপেক বলে ডাকবে কি না’।

সানুশা নাইডুর মতে,নতুন সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সম্ভবত তেলের দাম ও তেল প্রাপ্তির বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। ‘রাশিয়া ছাড়া ব্রিকসের মূল সদস্যদেশগুলো জ্বালানি তেল উৎপাদন করে না।তারা তাদের অর্থনীতি চালু রাখতে চায় এবং কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার জেরে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চায় না,’ আল-জাজিরাকে বলছিলেন তিনি।

অনেকে ব্রিকসকে মনে করেন ‘গ্লোবাল সাউথ’ বা বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হিসেবে।এসব দেশের অনেকগুলোই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার ‘অন্যায্য’ আচরণের শিকার বলে প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে।

কিন্তু ব্রিকসের সম্প্রসারণকে পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যম অবশ্য এখনই খুব গুরুত্ব দিতে নারাজ।ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ব্লুমবার্গের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে,নতুন সদস্যসহ ব্রিকসের সাধারণ ‘দর্শন’ হলো বাণিজ্য,প্রযুক্তি ও সামরিক লেনদেনে আরও বেশি দর-কষাকষির ক্ষমতা অর্জন করা,আর এই লেনদেন তারা করবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে।

ভারতের উদাহরণ দিয়ে এতে আরও বলা হয়,দেশটির প্রয়োজন কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কাছে থেকে সস্তায় পণ্য ক্রয়,কম দামে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা,যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংগ্রহ আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগ।তাই কারও পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সতর্ক হতে হয়।

একই সঙ্গে চাল আর চিনি রপ্তানি নিষিদ্ধ করে ভারতের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্যভাবে বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি জানানোও সম্ভব নয়।এ ক্ষেত্রে চীনের ওপরে সবার আস্থা বেশি,কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে।ক্রমবর্ধমান একটি শূন্যতা দেখার জন্য হয়তো রাশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না,ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে।

ব্রিকসের সদস্য হলে এখনই যে খুব লাভ হবে,ব্যাপারটা এমন নয়।কারণ জোটে চীন সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ এবং সব দেশের সঙ্গেই চীনের উল্লেখযোগ্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য রয়েছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টার-আমেরিকান ডায়ালগের এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা-বিষয়ক পরিচালক মার্গারেট মায়ার্স মনে করেন,ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এখনো ছোট। অন্যদিকে, জোটের সম্প্রসারণের বিষয়টি কমবেশি প্রতীকী মনে হলেও এর মানে এই নয় যে এর কোনো গুরুত্ব নেই।

গার্ডিয়ানকে মার্গারেট মায়ার্স বলেন,এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জি-৭ ও অন্যান্য উন্নত দেশের উচিত হবে না এই জোটকে এক কথায় খারিজ করে দেওয়া।নতুন সদস্য,বিশেষ করে তেল উৎপাদনকারীরা জোটে যোগ দিচ্ছে,ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ও জনসংখ্যার একটি বড় হিস্যা ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর হাতে থাকবে।

আরও খবর

Sponsered content