আন্তর্জাতিক

বিবিসিকে কেউ কেউ দেশের সুপ্রিম কোর্টেরও ঊর্ধ্বে মনে করেন!”

  প্রতিনিধি ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ , ১:৪০:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।বিবিসির মোদি তথ্যচিত্র: ভারতে কেন এতো কড়া প্রতিক্রিয়া?ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্যচিত্র নিয়ে দেশটিতে তোলপাড় চলছে।গত মঙ্গলবার রাতে দিল্লির জেএনইউ ক্যাম্পাসে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একদল শিক্ষার্থী বড় পর্দায় মোদিকে বিবিসির আলোচিত তথ্যচিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল।সেটি দেখার জন্য বিশাল জমায়েতও হয়েছিল।কিন্তু জেএনইউ কর্তৃপক্ষ এরপরই ছাত্র সংগঠনের অফিসে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন করে দেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,অন্ধকারের মধ্যেই শত শত ছাত্রী কিউ আর কোড শেয়ার করে নিজেদের মোবাইল বা ল্যাপটপে তথ্যচিত্রটি দেখতে শুরু করেন।এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ছাত্রগোষ্ঠীর পাথরবৃষ্টি।ক্যাম্পাসে ঢোকে দিল্লি পুলিশও,নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে তারা।

গভীর রাতে জেএনইউ-তে সেই মারপিট ও ধস্তাধস্তির পুনরাবৃত্তি দেখা গেল এদিন রাজধানীর আর একটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতেও।আর সেখানেও উপলক্ষ্যে ছিল একই-বিবিসির তথ্যচিত্রটি দেখানো।

জামিয়াতেও কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বামপন্থী ছাত্রদের একটি সংগঠন বড় পর্দায় ডকুমেন্টারিটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল।কিন্তু দুপুরে দাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে তাদের সেই আয়োজন তছনছ করে দেয়।পূর্ব দিল্লিতে জামিয়ার ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে,ডজনখানেক ছাত্রকে পুলিশ তুলেও নিয়ে যায়।

এর আগে গত ৪৮ ঘণ্টায় তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটি, কেরালার কোচি ইউনিভার্সিটিসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা এই ডকুমেন্টারির প্রথম পর্বটি প্রকাশ্যে দেখানোর ব্যবস্থা করে।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়) বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতেও এই তথ্যচিত্রের স্ক্রিনিং হবে বলে ঘোষণা করা হয় এবং সর্বত্রই আয়োজক ছাত্রগোষ্ঠীগুলো এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে সরকারি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তাদের এই পদক্ষেপ।

বস্তুত তিন বছর আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যেরকম স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখা যায়,অনেকটা একই ধরনের দৃশ্য যেন আবার দেখা যাচ্ছে ভারতের নানা প্রান্তে –যদিও প্রতিবাদের বিষয়টা এখানে ভিন্ন।

আর এখানেই এই প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে,কেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে যারা নিজেদের দাবি করে থাকে সেই শক্তিশালী ভারত কেন বিবিসির মাত্র ৫৮ মিনিটের (প্রথম পর্ব) একটা তথ্যচিত্রে এত কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাল?

আর কেনই বা ইউটিউব বা টুইটারকে নির্দেশ দিয়ে তারা এই তথ্যচিত্রের সব লিঙ্ক ব্লক করতে বলল?

‘উপেক্ষা করলেই ভাল হত’

ভারতের বর্ষীয়ান সম্পাদক ও দ্য হিন্দু পত্রিকাগোষ্ঠীর প্রধান এন রাম মনে করেন,সত্যিকারের পরিণত একটি সরকার হলে তারা এই ধরনের একটি তথ্যচিত্রে ‘নো কমেন্টস’ বলেই জবাব সারত এবং পুরোপুরি উপেক্ষা করত।

বাস্তবে কিন্তু দেখা গেছে ভারত সরকার এটিকে ‘প্রোপাগান্ডা পিস’ বলে বর্ণনা করেছে এবং এতে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে। দেশের আইনমন্ত্রী পর্যন্ত কটাক্ষ করে বলেছেন,“

এন রাম এই জন্যই বলছেন, “এই যে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সরকার যাকে বলে একেবারে ‘গন ব্যালিস্টিক’ (যেন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে),এটাই একেবারে আত্মঘাতী পদক্ষেপ হয়েছে। সরকার নিজেদের জালে নিজেরাই বল ঢুকিয়েছে।”

বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র,যিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে লাগাতার বিবিসির তথ্যচিত্রর লিঙ্ক শেয়ার করে চলেছেন,তিনিও মনে করেন ভারতে তথ্যচিত্রটি আটকাতে গিয়েই সরকার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে উসকে দিয়েছে।

বিবিসিকে মৈত্র বলছিলেন, “ডকুমেন্টারিটা ভাল,খারাপ বা কুৎসিত হতে পারে – কিন্তু সেটা আমরা ঠিক করব,যারা দেখছি।সরকার কোনও সাহসে বলে কোনটা আমরা দেখব বা কোনটা দেখব না?”

তথ্যচিত্রের কনটেন্টে সরকারের ‘ভয় পাওয়ার মতো বিষয়’ আছে বলেই তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এটির লিঙ্ক ব্লক করতে চাইছে – তা নিয়েও মহুয়া মৈত্রর কোনও সন্দেহ নেই।

ভারতের আর একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তাভলিন সিং টুইটারে (পরিচালক শেখর কাপুরকে উদ্দেশ্য করে) লিখেছেন, “বিবিসির একটা ডকুমেন্টারি যদি ভারতকে ডিস্টেবিলাইজ (অস্থিতিশীল) করতে পারে,তাহলে ভারতের পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন না-দেখাই ভাল।”

সেই তাভলিন সিংও বিবিসিকে বলেন, “পুরো ঘটনাক্রম দেখে আমার মনে হয়েছে এই ডকুমেন্টারিতে যে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে সেগুলোর সামনে দাঁড়ানোর মতো সৎ সাহস এদেশে ক্ষমতাসীনদের নেই।আর সে কারণেই তারা মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।”

মোদি ইমেজ রক্ষাই উদ্দেশ্য?

ভারত সরকার কেন এ ধরনের কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তার আর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক মহম্মদ সাজ্জাদ।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন,এদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন,২০০২তে গুজরাটে মুসলিমরা উচিত শিক্ষা পেয়ে গেছে।কাজেই সেই একই বিষয় নিয়ে বিবিসির করা তথ্যচিত্র কেন তারা আটকাতে যাবেন, সেটা একটু অবাক করারই মতো বিষয়।”

“আসলে এর একটাই কারণ হতে পারে,সারা দুনিয়ার সামনে ভারত নরেন্দ্র মোদীর একটা অন্য রকমের ইমেজ তুলে ধরতে চায়।সেই ইমেজটা বিশ্বগুরুর,বিশ্বনেতার,সমাজ ও অর্থনীতির কান্ডারীর।”

“কিন্তু বিবিসির তথ্যচিত্র তাঁর জন্য বিব্রতকর অন্য একটা ছবি তুলে ধরছে বলেই সরকারের জন্য এটা হজম করা কঠিন”,বলেন মহম্মদ সাজ্জাদ।

বস্তুত গত কয়েকদিনে বিজেপির একাধিক প্রথম সারির নেতাও এই প্রতিবেদককে বলেছেন, বিবিসি কেন এখন এই তথ্যচিত্রটি প্রচার করল, সেই ‘টাইমিং’-টা তাদের কাছে সন্দেহজনক ঠেকছে।

নাম প্রকাশ না-করার শর্তে তাদের বক্তব্য ছিল,মাত্র কয়েক মাস আগেই সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাট দাঙ্গার যাবতীয় দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

পাশাপাশি, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ২০টি দেশের জোট জি-টোয়েন্টির বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত এখন সেপ্টেম্বরে শি-বাইডেন-পুতিন-মোদী সহ বিশ্বনেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে –আর ঠিক তখনই নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হচ্ছে বলে তাদেরও সন্দেহ।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচও মনে করছে,ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা ও বিজেপি নেতাকর্মীরা গত কয়েক বছর ধরে বহু পরিশ্রমে ও সযত্নে মোদির একটি বিশেষ ধরনের ইমেজ গড়ে তুলেছেন।

“আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যখনই মোদীর সামান্যতম সমালোচনা হয়েছে,ভারতের কূটনীতিকরা অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে তা প্রতিহত করতে চেয়েছেন”,সোমবার তাদের এক বিবৃতিতে বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

স্বপন দাশগুপ্তর যুক্তি

বিবিসির ওই ডকুমেন্টারিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির একমাত্র যে নেতা ‘অন রেকর্ড’ ইন্টারভিউ দিয়েছেন,তিনি দলের রাজ্যসভা এমপি স্বপন দাশগুপ্ত।

এছাড়া এই তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে ভারত সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়ে তাদের প্রতিও বিবিসি অ্যাপ্রোচ করেছিল (‘রাইট টু রেসপন্স’),কিন্তু সরকার তাতে কোনও সাড়া দেয়নি।

তবে ভারতের একটি টিভি চ্যানেলকে মি দাশগুপ্ত মঙ্গলবার বলেছেন,বিবিসি কী উদ্দেশ্য নিয়ে তথ্যচিত্রটি বানাচ্ছে সে সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না।তবে ‘প্রশ্নের ধরন দেখেই’ বিষয়টি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ভারত সরকার কেন এই তথ্যচিত্রটি উপেক্ষা না-করে এটি বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে,তারও নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বপন দাশগুপ্ত।

ভারতের এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “সোজা কথা হল, এই তথ্যচিত্রে ভারতকে এবং ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে হেয় করা হয়েছে, যার পর সরকারের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়।”

তিনি আরও দাবি করেন,তথ্যচিত্রে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ভারতের বিচারবিভাগ পক্ষপাতপূর্ণ –এ দেশের আদালত শুধু শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেই রায় দিয়ে থাকে।“অথচ আমরা সবাই জানি এটা কত বড় মিথ্যে”,বলেন মি দাশগুপ্ত।

“গুজরাটে ২০০২ এর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার একটা অন্তিম ‘ক্লোজার’ কিন্তু আমরা গত বছরেই পেয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু এই ডকুমেন্টারি সেই ঘটনাকে নতুন আকারে প্যাকেজিং করে আবার সেই যন্ত্রণাকে খুঁচিয়ে তুলতে চেয়েছে”,মন্তব্য করেন তিনি।

ব্রিটেনের একটি ‘প্রাইভেট’ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই ধরনের অপচেষ্টার পর ভারত সরকারের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব ছিল না বলেই যুক্তি দিচ্ছেন স্বপন দাশগুপ্ত।তাঁর দলের বহু সতীর্থও এই ব্যাখ্যাতেই সায় দিচ্ছেন।

আরও খবর

Sponsered content