আন্তর্জাতিক

আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করার পর আজ দেড় বছর হলো

  প্রতিনিধি ৩০ মার্চ ২০২৩ , ১:১৫:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।আফগানিস্তানের নতুন নেতারা সংলাপে এবং মতবিনিময়ে বিশ্বাসী।কিন্তু তালি দিতে তো দুই হাত লাগে।৫ আগস্ট, ২০২১ ইসলামিক আমিরাত আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করার পর আজ দেড় বছর হলো।এর মধ্যে দেশের পরিস্থিতির অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।কাবুলে নতুন সরকার আসার পর ‘কেয়ামত’ ঘটবে বলে সমালোচকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।কিন্তু হয়েছে ‘উল্টা’—গত ১৮ মাসে সহিংসতার মাত্রা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে।

এমনকি আলোচনার সময় দোহার হোটেল লবিতে অনেক কূটনীতিকও আশঙ্কা করেছিলেন,তাদের দাবি পূরণ না হলে আরেকটি ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধ বাঁধবে।ইসলামিক এমিরাতের নেতারা তাদের আতঙ্ককে বিবেচনায় নিয়েছেন এবং এমন পরিণতি এড়াতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

সুতরাং নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময়ই আমরা আফগানদের উদ্বেগে সাড়া দিয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছি এবং ইসলামের ভ্রাতৃত্বের মানবিক ইসলামিক বার্তা আমলে নিয়ে একটি নতুন যুদ্ধের সম্ভাবনাকে দুর্বল করার পদক্ষেপ নিয়েছি।

আজ শুধু যুদ্ধই শেষ হয়নি,আফগানিস্তান পরিচালিত হচ্ছ একটি স্বাধীন,শক্তিশালী,ঐক্যবদ্ধ,কেন্দ্রীয় ও দায়িত্বশীল সরকারের হাত ধরে,যা গত চার দশকে এই প্রথম দেখা গেছে।

তারপর সরকার আফগানিস্তানকে বিদেশি সাহায্যের নির্ভরতা থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।একই সঙ্গে আমরা সবকটি সেক্টরকে ‘আফগানাইজিং’ করছি,স্থানীয় জনগণের চাহিদার প্রতি তাদের আরও দায়বদ্ধ করে তুলছি,সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়নে মনোযোগ বাড়াচ্ছি।আরও প্রবলভাবে অনুভব করছি যে,আমরা এই ভূখণ্ডের মালিক।

আমরা বুঝি,আধুনিক সম্পর্কের বিশ্বজনীন দাবি হলো, সকল রাষ্ট্রনেতা অপরের সঙ্গে সম্প্রীতি ও শান্তিতে থাকতে শিখবে। যে-সম্পর্কের ভিত্তি হবে সমতা,পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার অপরিবর্তনীয় নীতি।তাই আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার আবারও বিশ্বের কাছে ইতিবাচক সম্পর্কের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

আমরা মনে করি,আফগানিস্তান ও বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের এক অনন্য সুযোগ এসেছে।আফগান সমাজের ঐক্য ও সংহতি আগের চেয়ে শক্ত হয়েছে।আমাদের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে আমরা গর্ব করি,উদযাপন করি।

আমরা বিশ্বাস করি না,সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া যায়।আমাদের দৃষ্টিতে,দেশের প্রতিটি নাগরিক সামষ্টিক অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উচিত আফগানদের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা জানানো এবং তাদের নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করার মাধ্যমে সম্পর্কের বন্ধনে এগিয়ে আসা।

আমাদের বৈদেশিক নীতি হবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাধীন পদ্ধতির ভিত্তিতে,যা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়িয়ে যাবে।আমরা সমতা ও সম্মানের নীতিতে পরস্পরের স্বার্থ দেখব এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সুযোগ অনুসরণ করব।

আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়-আশয় নিয়ে প্রায়শই ভুল চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে।সুতরাং আফগানিস্তানের মূল্যবোধ ও চাহিদাগুলির একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরা দরকার।আমাদের সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা বুঝতেও সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।সব সরকার এই ধরনের সংবেদনশীল ক্ষেত্রে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখে না,ফলে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

আমরা বিশ্বাস করি,সংলাপ ও মতবিনিময় প্রয়োজন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপ মুক্ত পরিবেশে।যার লক্ষ্য হবে,বাস্তব সমাধান খুঁজে বের করা এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করা।

অতীতের অভিজ্ঞতা দেখায় যে,মানুষের দুঃখকষ্টকে হাতিয়ার বানালে ফল ভালো হয় না।আফগানিস্তানের চলমান মানবিক সংকটের নিরসন করা আমাদের যৌথ নৈতিক দায়িত্ব।গণ-দুর্ভোগকে চিরস্থায়ী করে রাজনৈতিক ছাড় পেতে চাওয়া সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

সন্দেহ নেই,চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যাংকিং বিধিনিষেধ আরোপ।যা মানবিক সংকট মোকাবেলায় আমাদের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত এবং বিলম্বিত করছে।

আফগান জনগণের চেতনা ও উদ্যোগ বিকাশে স্পেস দেওয়া উচিত।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আফগানিস্তানের বাজেয়াপ্ত সম্পদ রিলিজ করা এবং দোহা-চুক্তি মতে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া।একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কী নৈতিক কিংবা রাজনৈতিক যুক্তি থাকতে পারে?

আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদের মনে করিয়ে দিই যে, নিষেধাজ্ঞা ও চাপ মতপার্থক্যের সমাধান করে না,সমাধান আসে পারস্পরিক আস্থার মাধ্যমে।আগেও বহুবার ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং সরকার ভেঙে পড়ার ইতিহাস আফগানিস্তানের রয়েছে; বৈশ্বিক শক্তি একজোট হয়েও তা আটকাতে পারে নি।

এই সরকারকে দুর্বল করার পরিণতি কী হবে?নিশ্চিত তখন আবার একটা বিরাট মানবিক ট্র্যাজেডির উদ্ভব হবে,যা শুধু আফগানিস্তাকে নয়,বরং আমাদের প্রতিবেশীসহ গোটা বিশ্বকে নতুন করে অপ্রত্যাশিত নিরাপত্তা,উদ্বাস্তু,অর্থনৈতিক,স্বাস্থ্য ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে।

তিক্ত বাস্তবতা হলো,গত দুই দশকে আফগান অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ বিদেশি সাহায্য নির্ভর,যা অনেকটা আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে।আমাদের সুপারিশ হলো,বিদেশি সাহায্য বন্ধ নয়, বরং তা অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো প্রকল্পগুলি সম্পূর্ণ করতে।অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত না করে কেবল অর্থের ব্যাগ হাতবদল করলে লাখো মানুষের টেকসই জীবিকার সংস্থান কখনও গড়ে উঠবে না।

সুতরাং প্রথম কাজ হলো নিষেধাজ্ঞা অপসারণ,তাহলে বেসরকারি খাত পুনর্জীবন পাবে।আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং জাতীয় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের বাধা দূর হবে।এক্ষেত্রে একটি অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং পরস্পরের স্বার্থ রক্ষা করে যে-কোনও রাষ্ট্রের সাথে কাজ করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।সবার স্বার্থেই একটি স্বনির্ভর আফগানিস্তান দরকার,ব্যর্থ আফগানিস্তান সবাইকে বিপদে ফেলে দেবে।

আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান জানিয়ে আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাতের সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের তাই বিকল্প নেই।

গত দেড় বছরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে।যদিও উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলাম আমরা একটি ধসে পড়া মাদক-রাজ্য,একটি শূন্য কোষাগার,বকেয়া বিলের আহাজারি,লক্ষ লক্ষ মাদকাসক্ত, ব্যাপক দুর্নীতি, সার্বজনীন দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং স্থবির অর্থনীতি।

আমরা একটি পেশাদার নিরাপত্তা বাহিনি গঠন করেছি, দেশব্যাপী নিরাপত্তা বজায় রেখেছি এবং নিশ্চিত করেছি, কেউ যেন অন্য দেশের বিরুদ্ধে আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার না করে।আমরা মাদকের চাষ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছি। যারা এখনও সন্দিহান,তাদের আমরা আফগানিস্তানে এসে নিজ চোখে সত্যতা দেখে নিতে স্বাগত জানাই।

কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম একটি আফগান সরকার তার বাজেটের পুরোটাই দেশীয় রাজস্ব থেকে সংগ্রহ করেছে। অতীতে সরকারি বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি থাকত বৈদেশিক অনুদান।তা ছাড়া সরকার এবার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয়করণ করেছে।জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই অগ্রগতির প্রতিফলন ঘটেছে।

সরকার দুর্নীতি দমন করেছ।অতীতে আফগানিস্তান সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল।আফগানদের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ কিংবা বিদেশ গমনও সহজ হয়েছে।পাবলিক সেক্টরের আকার বেড়েছে,সাথে আমরা পূর্ববর্তী প্রশাসনের প্রায় ৫ লাখ সদস্যকেও ধরে রেখেছি।

স্বীকার করি যে,চ্যালেঞ্জ এবং ঘাটতি রয়েছে নিশ্চয়।কিন্তু সমাধানের জন্য সময়,উপায় এবং সহযোগিতাও প্রয়োজন। বিশ্বের কোন দেশ সমস্যা মুক্ত,তবে আমরা এড়িয়ে যাওয়া কিংবা বাড়িয়ে তোলার বদলে সহায়তা ও কমিয়ে আনাকে বেছে নিতে চাই।

দেখুন,গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক সামরিক জোট এখানে কয়েক লক্ষ সৈন্য এনেছে এবং খরচ করেছে ট্রিলিয়ন ডলার,তারপরও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পায় নি।এখনও তারা নতুন পাতা না উল্টিয়ে বরং অতীতে বাস করছে।বারবার সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ থেকে চোখ ফিরিয়ে অভিযোগ আর চাপের নীতি গ্রহণ করেছে।তাদের বোঝা দরকার— এক হাতে তালি বাজতে পারে না।

বর্তমান সরকারের অধীনে আফগানিস্তানের ২০ মাস পূর্তি উপলক্ষে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির আলজাজিরায় লেখা কলামটি অনুবাদ করেছেন- মনযূরুল হক

আরও খবর

Sponsered content