প্রতিনিধি ১২ জানুয়ারি ২০২৩ , ২:৩৯:৪৮ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।মন্দার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি।নানা ধরনের ঝুঁকিতে অবস্থা সঙিন।সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক এ কথা বলেছে।
এর রেশ কাটতে না কাটতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ঝুঁকি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির প্রধান পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে তারা। বাংলাদেশের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতির প্রধান ঝুঁকি।
ঝুঁকির পাঁচটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে ডব্লিউইএফ।উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আরও যে চারটি ঝুঁকির খাত তারা চিহ্নিত করেছে,সেগুলো হলো ঋণসংকট,উচ্চ পণ্যমূল্যের ধাক্কা, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি ও সম্পদের জন্য ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।এটি মূলত ধারণাভিত্তিক জরিপ।জরিপে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়,আগামী দুই বছরে আপনার দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনগুলো।’
অংশগ্রহণকারীদের ৩৫টি ঝুঁকির তালিকা দেওয়া হয়।সেখান থেকে তাঁরা পাঁচটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করেন।
দেশে এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া।২০২১ সালের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়েছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে,২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।পরের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হয়।ওই দুই মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল।
পরিসংখ্যান অনুসারে,২০২২ সালের আগস্টে গত ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল।২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনো ৯ শতাংশের বেশি হয়নি।উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
অর্থনীতির পাঁচ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অংশীদার হিসেবে কাজ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। মোট ৭২ কোম্পানির ওপর জরিপ করে ঝুঁকির তালিকা প্রস্তুত করেছে তারা।
২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতির হার কমার সম্ভাবনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,দেশের মূল্যস্ফীতি অনেকাংশে আমদানিনির্ভর। বিশ্ব অর্থনীতির যে বাস্তবতা,তাতে ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের সম্ভাবনা তেমন একটা নেই বলে মনে করেন তিনি।বলেন,অনিশ্চয়তার কারণে রপ্তানিকারকেরা আগে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারপর রপ্তানি করছেন। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।আবার দেশের আমদানি কয়েকটি গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ। তাঁরা যখন ঝুঁকি দেখেন,তখন আমদানি কমিয়ে দেন,পাছে বিক্রি না হয় এই ভয়ে। সে কারণেও বাজারে চাপ পড়ে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন,খাদ্য মূল্যস্ফীতির বড় কারণ ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি।সেই সঙ্গে আছে জ্বালানির উচ্চ মূল্য।শীতকাল শেষ হলে ইউরোপে জ্বালানির চাহিদা কিছুটা কমবে,কিন্তু তা এতটা কমবে না যে মূল্যস্ফীতি এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যাবে।তবে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ভালো অবস্থায় আছে।সারের সরবরাহ ঠিক থাকলে দেশি খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি হবে না।
এদিকে শ্রীলঙ্কার ঋণসংকটের পর বাংলাদেশ ঋণসংকটে পড়বে কি না,২০২২ সালে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। জনমনে একধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়,বাংলাদেশ যেভাবে বিদেশি ঋণে বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে,তাতে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণসংকট হবে কি না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে,নতুন ঋণচুক্তি না হলে,শুধু পাইপলাইনে থাকা প্রতিশ্রুতি থেকে ঋণ পেলে এবং আগামী কয়েক বছরে ঋণ পরিশোধে কী পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে ও ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ কত হবে।দেখা গেছে,২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে।এরপর ঋণ পরিশোধ কমতে থাকবে।
এ প্রসঙ্গে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,জরিপটি এ মুহূর্তে করা হলে ঋণসংকট প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হতো।সরকার ঋণসংকট মোকাবিলায় যে চেষ্টা করছে,তা মূলত সময়ক্ষেপণমূলক।সেটা আমাদের চাহিদা মেটানোর মতো নয়, অবশ্য এ সময় তা প্রত্যাশা করা ঠিক নয় বলে তিনি মনে করেন।এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের প্রাধিকার নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে মিল থাকা উচিত।সেটা হলে সরকারের অনেক অর্থ সাশ্রয় সম্ভব।
বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে সব বৈশ্বিক সংস্থা বলছে,চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির গতি আরও কমে যাবে।মন্দা না হলেও প্রবৃদ্ধির ধীরগতির কারণে মানুষের আয় কমে যাবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারও একেবারে কমে যাবে না। বিশ্ব অর্থনীতিতে এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের গায়েও তার আঁচ লাগবে।
তাই দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে সহায়তা চায় দেশটি। তারই ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা ৯ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও দেশটির সংকট মোকাবিলায় প্রায় ১ হাজার ৬৩০ কোটি ডলার সহায়তা চেয়েছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
চলমান অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতিতে পাকিস্তান জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথভাবে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছে। এ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়া। এ সম্মেলনের বৈঠকের এক ফাঁকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী আইএমএফের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে কয়টি দাতা সংস্থা এগিয়ে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), বিশ্বব্যাংক এবং সৌদি আরব। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ফ্রান্সও এ সহায়তায় অংশ নেবে। জেনেভায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রব্বানি। বেশ কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে বড় অঙ্কের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘এমন প্রতিশ্রুতি আমাদের আশাবাদী করেছে।আমরা এ–ও মনে করি যারাই দুর্যোগে পড়বে,বিশ্ব তাদের পাশে দাঁড়াবে।’