অপরাধ-আইন-আদালত

এহসান গ্রুপ গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া ১০১ কোটি টাকা কি ফেরত পাবে?

  প্রতিনিধি ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ২:১০:৩৪ প্রিন্ট সংস্করণ

পিরোজপুর জেলা প্রতিনিধি।।পিরোজপুর পৌরসভার খুমুরিয়া মহল্লার মো. ইব্রাহিম (৭০) অবসরের আট লাখ টাকা এহসান গ্রুপে আমানত রেখেছিলেন।ছয় মাস লভ্যাংশ পাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।অনেক ঘোরাঘুরি করেও আমানতের টাকা ফেরত পাননি তিনি।বরং টাকা চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান গ্রেপ্তারের পর ইব্রাহিম ভেবেছিলেন,জামানতের টাকা ফেরত পাবেন।কিন্তু গত দেড় বছরে ইব্রাহিমসহ কোনো গ্রাহক টাকা ফেরত পাননি।

রাগীব আহসান,তাঁর বাবা ও তিন ভাইকে গ্রেপ্তার এবং তাঁদের সম্পদ আদালতের নির্দেশে ক্রোক করার পরও আমানতের টাকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন ১০ হাজারের বেশি গ্রাহক।

গ্রাহক মো. ইব্রাহিমের ছেলে মো. হাসান বলেন,বাবার কাছে যত টাকা ছিল সবই এহসান গ্রুপে আমানত রাখা হয়েছে। এখন আমি মাসে আট হাজার টাকা বেতন পাই।সেই টাকা দিয়ে পাঁচজনের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে।এহসান গ্রুপে জমা রাখা টাকাটা পেলে হয়তো ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বাড়তি আয় করা যেত। আমাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো।’

আদালত রাগীব আহসান ও তাঁর সহযোগীদের নামের অনুকূলে ৪০টি দলিল এবং রাগীব আহসান,তাঁর ভাই আবুল বাশার,খাইরুল ইসলাম,শামীম হাসান,মাহমুদুল হাসান ও রাগীব আহসানের স্ত্রী সালমা আহসানের নামে মোট পাঁচটি বিক্রয় করা দলিলও ক্রোকের নির্দেশ দেন।আদালতের নির্দেশে দলিলসহ ১৭৭ শতাংশ জমি ক্রোক করা হয়।ওই সম্পদের মধ্যে এহসান গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের বহুতল ভবন রয়েছে। এহসান গ্রুপের ২৫টি ব্যাংক হিসাবে ১২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে।এসব সম্পদ ও ব্যাংকে থাকা টাকা দিয়ে এত গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে পিরোজপুর আদালতের সরকারি কৌঁসুলি খান মো. আলাউদ্দিন বলেন,গ্রাহকের টাকা প্রতারণার মামলাগুলো বিচারাধীন।এসব মামলার রায়ের পর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।

পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন,আদালতের নির্দেশে এহসান গ্রুপের বেশ কিছু সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে।আমরা এহসান গ্রুপের ব্যাপারে আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবেন,সেভাবে কাজ করব।’

পিরোজপুর ও আশপাশের এলাকার ১০ হাজারের বেশি আমানতকারীর শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে।পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সূত্র জানায়,প্রতিষ্ঠানটি চারটি সমবায় সমিতির নামে সঞ্চয় করা টাকা,ডিপিএস ও একটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে আমানতকারীদের কাছ থেকে এক দশক ধরে এসব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকা থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রাগীব আহসান ও তাঁর ভাই আবুল বাশার খানকে আটক করে র‍্যাব।ওই দিনই রাগীব আহসানের অপর দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খাইরুল ইসলামকে আটক করে পিরোজপুর থানার পুলিশ।

এ ঘটনায় পিরোজপুর সদর উপজেলার মূলগ্রাম গ্রামের বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে রাগীব আহসান ও তাঁর চার ভাইকে আসামি করে স্থানীয় থানায় ৯৭ জন গ্রাহকের ৯১ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন।মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।বর্তমানে তাঁরা চার ভাই ও তাঁদের বাবা আবদুর রব খান কারাগারে।এই নিয়ে রাগীব আহসানসহ এহসান গ্রুপের উপদেষ্টা ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় পিরোজপুরে ১৯টি মামলা হয়েছে।এসব মামলার বাদী সবাই প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ও কর্মী।

একটি মামলার বাদী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী হেমায়েত উদ্দিন (৬৩) বলেন,শুনেছিলাম এহসান গ্রুপ ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।তাই অবসরের ১৫ লাখ টাকা রেখেছিলাম। এখন এ টাকা কীভাবে ফেরত পাব,সেই চিন্তায় আছি।’

এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তাঁর ভাই আবুল বাশার খানকে শুক্রবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সামনে আনা হয়
পিরোজপুর সদর উপজেলার কালীকাঠি গ্রামের মনিরা ইয়াসমীন (৪৭) বলেন,বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া জমি বিক্রি করে ও জমানো ১৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকা এহসান গ্রুপে রেখেছিলাম।কয়েক মাস লভ্যাংশ পেয়েছিলাম।

এরপর টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।আমার স্বামী ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন।একটু ভালো থাকার আশায় সহায়-সম্বল সব এহসান গ্রুপে আমানত রেখে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি।’

সিআইডির করা মামলার সূত্রে জানা যায়,এহসান গ্রুপ গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া ১০১ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছে।২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর পিরোজপুর সদর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেন সিআইডির পরিদর্শক মীর কাশেম।মামলায় রাগীব আহসান,তাঁর স্ত্রী ও চার ভাইকে আসামি করা হয়।ওই মামলায় ২০২২ সালের ১৩ জুন এহসান গ্রুপের সব স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

আমানতকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,২০০৮ সাল থেকে এহসান গ্রুপ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আমানত নিয়ে ব্যবসা করে আসছিল।প্রতি এক লাখ টাকা আমানতের বিপরীতে মাসে ২ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে তাঁদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে।

২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের মাসিক মুনাফা ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দেয়। মূলত এহসান গ্রুপ শরিয়াহ সম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগের প্রচারণা চালিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন।ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের আড়ালে ব্যবসায়িক প্রচারণা চালাতো প্রতিষ্ঠানটি।

এহসান গ্রুপের কর্মী বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার চিংড়াখালী গ্রামের আক্তারুজ্জামান বলেন,১০ হাজারের বেশি মানুষ এহসান গ্রুপে টাকা রেখে সাড়ে তিন বছর ধরে ঘুরছেন।টাকা আদৌ ফেরত পাব কি না,তা জানি না। আমাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’

আরও খবর

Sponsered content