ইসলাম ও জীবন

‘জিহাদ’ না ‘হত্যা’—কোরআনের অপব্যাখ্যা ও রেডিক্যাল ইসলামিস্টদের বিপজ্জনক বয়ান

  প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৫:২৯:২১ প্রিন্ট সংস্করণ

বিশেষ প্রতিবেদন।।ইসলামের নামে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড চালানো রেডিক্যাল গোষ্ঠীগুলোর সবচেয়ে পরিচিত বয়ান—
“আমরা কাফের হত্যা করছি,কারণ আল্লাহ তা আদেশ দিয়েছেন।”

এই দাবির পক্ষে তারা প্রায়শই পবিত্র কোরআনের সূরা তওবা,আয়াত ৫ উদ্ধৃত করে।সাধারণ মানুষ যখন কোরআন খুলে আয়াতটি পড়ে,তখন বিভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।প্রশ্ন জাগে—ইসলাম কি সত্যিই মানুষ হত্যার নির্দেশ দেয়? তবে এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কোরআনকে খণ্ডিত নয়, পূর্ণ প্রেক্ষাপটে পড়তে হয়।

সূরা তওবা ৫: আয়াত, কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে?
সূরা তওবা ৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে—

> “অতঃপর নির্দিষ্ট মাসসমূহ অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর, যেখানে তাদের পাও…”
(সূরা তওবা: ৫)

রেডিক্যাল গোষ্ঠীগুলো এখানেই থেমে যায়।কিন্তু তারা যে বিষয়টি গোপন করে তা হলো—এই আয়াতটি কোন পরিস্থিতিতে নাজিল হয়েছিল।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মুসলিম ও মুশরিকদের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল

মুশরিকরা সেই চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালায়

সূরা তওবার ১–৪ নম্বর আয়াতে চুক্তি ভঙ্গ,সতর্কতা ও সময়সীমার কথা বলা হয়েছে

এরপর যুদ্ধাবস্থায় আত্মরক্ষামূলক নির্দেশ আসে
অর্থাৎ,এটি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে সামরিক নির্দেশ, সাধারণ মানুষ বা নিরপরাধ কাউকে হত্যার অনুমতি নয়।

যে আয়াত তারা ইচ্ছাকৃতভাবে লুকায়: সূরা তওবা ৬

রেডিক্যালদের সবচেয়ে বড় প্রতারণা হলো—সূরা তওবা ৬ নং আয়াত বাদ দেওয়া।

এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেন—
> “আর মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পারে। এরপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও।”
(সূরা তওবা: ৬)

➡️ অর্থাৎ:

যুদ্ধক্ষেত্রেও যদি শত্রু শান্তি বা আশ্রয় চায়
তাকে হত্যা করা নয়, বরং নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া ফরজ
এটি সরাসরি প্রমাণ করে—
ইসলাম নির্বিচারে হত্যা নয়,বরং শান্তিকেই অগ্রাধিকার দেয়।

কোরআনের মৌলিক নীতি: নিরপরাধ হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ

পবিত্র কোরআনে নিরপরাধ হত্যার বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে—

> “যে কেউ একজন মানুষকে হত্যা করল—সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল।”
(সূরা মায়িদা: ৩২)

এখানে:

‘একজন মানুষ’ বলতে মুসলিম বা অমুসলিম আলাদা করা হয়নি।নিরপরাধ যে কেউ—মানবজীবন সমানভাবে পবিত্র এ ছাড়া সূরা নিসায় বলা হয়েছে—

> “যে ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুমিনকে হত্যা করবে,তার প্রতিদান জাহান্নাম।”
(সূরা নিসা: ৯৩)

হাদিসে নবী (সা.) কী বলেছেন?
রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধের সময়ও স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন—

> “কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ, সন্ন্যাসী কিংবা নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করবে না।”
(সহিহ মুসলিম)

আরেক হাদিসে—

> “যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল,সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।”
(সহিহ বুখারি)
‘নবী বা আল্লাহকে গালি দিলে হত্যা’—এই ধারণা কি কোরআনিক?

কোরআনে কোথাও নেই—নবীকে গালি দিলে হত্যা করতে হবে।
আল্লাহ সম্পর্কে কটূক্তির শাস্তি মানুষ নিজ হাতে কার্যকর করবে।বরং কোরআনে বলা হয়েছে—

> “তোমরা তাদের গালাগালি কোরো না,যাদের তারা আল্লাহ ছাড়া ডাকে।”
(সূরা আনআম: ১০৮)
➡️ অর্থাৎ অপমানের জবাব অপমান নয়,বরং সংযম।

বিশ্লেষণ: কেন এই অপব্যাখ্যা ছড়ানো হয়?

বিশ্লেষকদের মতে—
ধর্মভীরু মানুষের আবেগকে কাজে লাগানো

সহিংস রাজনীতি ও ক্ষমতার স্বার্থ বাস্তবায়ন
এভাবেই “জিহাদ” শব্দকে সন্ত্রাসের হাতিয়ার বানানো হয়।

উপসংহার: জিহাদ মানে হত্যা নয়,আত্মসংযম ও ন্যায়ের সংগ্রাম।

ইসলামে—যুদ্ধ অনুমোদিত শুধু আত্মরক্ষা ও চুক্তি ভঙ্গের প্রেক্ষাপটে শান্তি চাইলে শত্রুকেও নিরাপত্তা দেওয়া ফরজ।
নিরপরাধ হত্যা মহাপাপ
পবিত্র কোরআন খণ্ডিত নয়, পূর্ণ প্রেক্ষাপটে বুঝে পড়তে হবে।না হলে—মানুষ নিজেও উগ্রতার শিকার হবে।অন্যকেও ভুল পথে ঠেলে দেবে।আর ইসলামকে ‘সহিংস ধর্ম’ হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে।

ইসলাম জঙ্গিবাদ শেখায় না।
অজ্ঞতা ও বিকৃত ব্যাখ্যাই জঙ্গিবাদ তৈরি করে।

আরও খবর

Sponsered content