প্রতিনিধি ২৭ জুন ২০২২ , ৫:৫০:২২ প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অমর একুশের গানের রচয়িতা বরেণ্য সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট ও গীতিকার বরিশালের কৃতি সন্তান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন’র সহযোগিতায় নাগরিক পর্ষদ, বরিশালের উদ্যােগে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এ নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতেই প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন সাংবাদিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দসহ ও ভাষা আন্দোলনের পরিবারের সদস্যরাসহ একাধিক সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
সিটি মেয়র ও নাগরিক পর্ষদ বরিশাল’র আহ্বায়ক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ’র সভাপতিত্বে নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী, পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেসন্স-এর চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, মূখ্য আলোচক ছিলেন লন্ডন বিবিসি প্রযোজক কাজী জাওয়াদ, আলোচক ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন ও নাগরিক পর্ষদ বরিশালের যুগ্ম আহ্বায়ক নজমুল হোসেন আকাশ।
উল্লেখ্য, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গত ১৯ মে লন্ডনে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রয়াণে শোকার্ত বরিশালবাসী। বিদগ্ধ এই বাঙালির প্রতি জাতির এই সূর্য সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজন করা হয় এই শোকাতুর অনুষ্ঠান। ১৯৩৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর বরিশাল মেহেদিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা-মাতা ছিলেন ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী ও জোহরা খাতুন ।
নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠানে বক্তাদের আলোচনায় উঠে আসে নানা তথ্য। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নিজেই কলাম-সাংবাদিকতায় এক ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন।তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় মেহেদিগঞ্জ উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসা প্রাথমিকে পড়ার পর হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫৩ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকায় এসেই রাজনৈতিক সং আমে নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে নিজেও আহত হয়েছিলেন। তবে পরিবার থেকেই আসে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা। তাঁর পিতা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী স্থানীয় জমিদার হলেও, ছিলেন অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলা কংগ্রেস সভাপতি। সদস্য ছিলেন অল ইন্ডিয়া কংগ্লাস ওয়ার্কিং কমিটির। গাফফার চৌধুরী যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, তখন কবিতা লেখা শুরু করেন। যষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রথম ছাপা হয়। স্কুলছাত্র থাকাকালেই তাঁর লেখা কলকাতার সওগাত, ঢাকার সোনারবাংলা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। ঢাকার প্রথম জীবনে সওগাত, মোহাম্মদী, মাহেনত, দিলরুবা প্রভৃতি মাসিক পত্রিকায় তাঁর গল্প উপন্যাস ছাপা । ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হন। দুই বছর পর ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’ সম্পাদনার ভার নেন তিনি। তবে পত্রিকাটি সামরিক শাসনের মধ্যে বেশিদিন বের হতে পারেনি। গাফফার চৌধুরী এরপর দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক জেহাদ এ কাজ করার পর ১৯৬৩ সালে সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক হন। এরপর দুই বছর ছাপাখানা খুলে ব্যবসায় নামলেও আবার ফেরেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে দৈনিক আওয়াজ বের করেন। ১৯৬৭ সালে আবার ফেরেন দৈনিক আজাদে। ১৮৬৯ সালে পুনরায় যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। মানিক মিয়া মারা গেলে দৈনিক পূর্বদেশে যোগ দেন তিনি। তার অগণিত সাড়াজাগানো কলাম পড়ে বিস্ময়-বিমুগ্ধ চিত্তে ভেবেছি, এত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন, এত অনুপুঙ্খ ঘটনার গভীর বিশ্লেষণ তিনি কীভাবে দেন! অতীত উদাহরণ তুলে এনে বর্তমানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কী করে পালটা যুক্তি খণ্ডন করেন! তিনি যে জাতিস্মর—এ বিষয়ে তাই দ্বিমত একদমই কম।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায়ই তিনি ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। পিতৃবন্ধু শ্রী দুর্গামোহন সেনের কাছেই তার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। বরিশাল হিতৈষী পত্রিকা দিয়ে শুরু; এরপর দৈনিক ইনসাফ, সংবাদ, মাসিক সওগাত, নকীব, দিলরুবা, দৈনিক ইত্তেফাক, মেঘনা, চাবুক, দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক জেহাদ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, দৈনিক আওয়াজ, দৈনিক পূর্ব দেশ, জয়বাংলা, বাংলার বাণী ছাড়াও প্রবাসজীবনে বাংলার ডাক, নতুন দিন, পূর্ব দেশ, জাগরণ ইত্যাদি পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এর বাইরে তিনি কলাম লিখেছেন দৈনিক ইত্তেফাক, আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ, প্রথম আলো, ভোরের কাগজ, যুগান্তর, সমকাল, ডেসটিনি, কালের কণ্ঠ, স্টেটসম্যান, ইনডিপেনডেন্ট, সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, বিচিত্রা, মৃদুভাষণসহ আরো বেশ কিছু পত্রিকায়। তার কলম চলেছে কালের মতোই নিরবধি। লেখালেখি ছাড়া তার জীবনে আর অন্য কর্ম ছিল না। তবে হ্যাঁ, ছাত্রজীবনে রাজনীতি শেষে সংসারধর্ম পালন করেছেন সত্য; তবে তা সাংবাদিকতা ও লেখালেখির ধর্মকে বাদ দিয়ে একদমই নয়। ভেবে বিস্মিত হই, একজন মানুষ গোটা জীবনই কীভাবে লেখালেখিতে কাটিয়েছেন এবং সংবাদপত্রের সঙ্গেই থেকেছেন! কী এক আশ্চর্য ক্ষমতা ও নেশা ছিল তার। কলাম লেখার সংখ্যায় তো ছিলেন বিশ্বে এক জীবন্ত কিংবদন্িত! মানি আর না মানি, তিনি এ ক্ষেত্রে এক অপার বিস্ময়। এক জীবনে তিনি যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-পরিচিতি, স্বীকৃতি-সম্মান, পদক পুরস্কার— সবই পেয়েছেন এবং নিজের পেশাজীবন উপভোগও করেছেন। আবার আলোচনা-সমালোচনা, নিন্দা-প্রশংসা সবই কুড়িয়েছেন। তাকে নিয়ে যত বিতর্ক হয়েছে, তেমনটা খুব কম সাংবাদিককে নিয়েই হয়েছে, তবে কোনো অবস্থাতেই দমে যাননি। এটাই তার সাহস, মনোবল ও বুদ্ধিমত্তা।
ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রাবস্থায় একুশে ফেব্র‚য়ারি নিয়ে তিনি যে কাঁচা হাতে পাকা গানটি লিখেছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র‚য়ারি’, সেটি ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে যে পাঁচটি গান সেরা বিবেচিত হয়েছে, তারই আলোকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের বিবিসি বাংলার তালিকায় তৃতীয় স্থান পেয়েছে, যার সুরারোপ করেছেন আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫২ থেকে ২০২১—এত বছরেও যে গানটির আবেদন এতটুকুও ম্লান হয়নি, বরং সময়ান্তরে আরো বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। আ গা চৌ সারা জীবন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে কলম চালনা করেছেন, সশস্র মুক্তিযুদ্ধের কালে তিনি মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ও স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয়বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের তথা স্বাধীনতার সপক্ষ সরকারের অনুকূলে তার সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ সমর্থন ও অবস্থান ছিল সদা বিদ্যমান।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি গাওয়া হয়েছে এ অবধি বাংলাসহ ১২টি ভাষায়—মালয়, আরবি, জার্মান, নেপালি, হিন্দি, ফরাসি, স্পেনীয়, রুশ, ইংরেজি, চীন ও ইতালীয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আওয়ামী লীগের মুখপত্র জয়বাংলা, কলকাতার যুগান্তর আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করছিলেন। ১৯৭১ সালে – মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিসহ পরিবারের সকলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক জনপদ বের করেন। ১৯৭৪ সালে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলার ডাক নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সাপ্তাহিক জাগরণ পত্রিকায়ও কিছুদিন কাজ করেন। ১৯৮৭ সালে নতুনদিন পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে নতুনদেশ এবং ১৯৯১ সালে পূর্বদেশ বের করেন। তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রাজনৈতিক কলাম লেখক হিসেবে, তাঁর লেখা কলামের ছিল অগণিত অনুরাগী পাঠক। পঁচাত্তরের ঘৃণা হত্যাকাজের প্রতিবাদ করেন তিনি লন্ডনের এক কাগজে লিখে। প্রতিকূল অবস্থায় তিনি লন্ডনে থেকে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৬ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে সহযাত্রীদের নিয়ে তিনি ক্রোড়পত্র বের করে নিহত জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালের ৫ই অক্টোবর স্ত্রীরসহ পরিবারের সকলকে নিয়ে লন্ডনে চলে যান। সেখানে নতুন দিন নামে একটি পত্রিকা বের করেন। প্রায় ৩৫টি বই লিখেছেন তিনি। তার লেখা বইয়ের মধ্যে ভয়ংকরের হাতছানি, সম্রাটের ছবি, ডানপিটে শওকত, চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, পলাশী থেকে ধানমন্ডি, শেষ বাজনার চাঁদ, কৃষ্ণপক্ষ অন্যতম। নিয়মিত কলাম লিখেছেন ঢাকা ও কোলকাতার বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইনে। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই।
জাতির পিতার হত্যাকান্ড বিষয়ে গাফফার চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘পলাশী থেকে ধানমন্ত্রী চলচ্চিত্র। বঙ্গবন্ধুর ওপরেই আরেকটি চলচ্চিত্র ‘দ্য পোয়েট অব পতি লটিকস’ প্রযোজনা করছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতির জন্য জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক, ইউনেসকো সাহিত্য পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক (২০০৯)। কিন্ত খ্যাতিমান লেখক-সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী গত ১৯শে মে বৃহস্পতিবার লন্ডনে না ফেরার দেশে গমন করেন। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে আমরা তাঁকে পাই একজন সক্রিয় প্রগতিশীল লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে। তিনি ইতিহাসের অংশীদার। জানা গেছে, হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর তিন স্ত্রীর ঘরে আট সন্তান। তিন পুত্র, পাঁচ কন্যা। আ গা চৌ তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান। তার মায়ের নাম জহুরা খাতুন। ’৭৩ সাল থেকে লন্ডনপ্রবাসী আ গা চৌ মৃত্যুকালে এক পুত্র ও চার কন্যা রেখে গেছেন (অনুপম, তনিমা, চিন্ময়ী, বিনীতা, ইন্দিরা– শুধু বিনীতা নেই)। সবাই ব্রিটিশ নাগরিক এবং উচ্চশিক্ষিত। তার স্ত্রী সেলিমা আফরোজ প্রয়াত হয়েছেন ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর।