অপরাধ-আইন-আদালত

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় খালাসের রায় বহালঃ-নতুন করে তদন্তে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার

  প্রতিনিধি ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ৫:৪১:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আসামিদের খালাস দিয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন,তা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

হাইকোর্টের রায়ের কিছু অংশ প্রত্যাহার ও সংশোধন সাপেক্ষে পর্যবেক্ষণসহ এ রায় দেওয়া হয়।হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল সর্বসম্মতিতে খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ আজ বৃহস্পতিবার এ রায় দেন।

এর আগে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর পঞ্চম দিনে গত ২১ আগস্ট শুনানি শেষ হয়সেদিন আদালত রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন।এর ধারাবাহিকতায় আজ রায় দেওয়া হয়।

সকাল ১০টা ৫ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারপতিরা।আসন গ্রহণের পর প্রধান বিচারপতি রায় ঘোষণা শুরু করেন।১০টা ১৮ মিনিটে রায় ঘোষণা শেষ হয়।

হাইকোর্টের রায় ন্যায়সংগত

তথ্য-প্রমাণ,পরিস্থিতি ও আইনি দিক পর্যালোচনা করে অভিমতে আদালত বলেন,হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) খারিজ, ্আপিল (বিচারিক আদালতের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল) মঞ্জুর ও বিবিধ আবেদনে রুল যথাযথ ঘোষণার পর আপিলকারী ও যারা আপিল করেননি তাদের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের দোষীসাব্যস্তকরা ও দণ্ডাদেশ বাতিল করে যে রায় দিয়েছেন, তা ন্যায়সংগত।

তথ্যাদি ও নথি পর্যালোচনা করে রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, মুফতি আবদুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি যেসব পরিস্থিতিতে গ্রহণ করা হয়েছে,তাতে তাঁর স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় প্রদান বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ সৃষ্টি করেছে;যেখানে তাঁর প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার দীর্ঘ চার বছর পর দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়।দীর্ঘ সময় পুলিশ হেফাজতে থাকার পর অপর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হলে তাঁরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।তিনজনের জবানবন্দি একজন ম্যাজিস্ট্রেট একই দিন গ্রহণ করেন।যা প্রযোজ্য আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।

রায়ে বলা হয়,অধিকাংশ অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁদের জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আবেদনের যুক্তিতে অমানবিক নির্যাতনের কথা বলেছেন।ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে তাঁদের বেআইনি হেফাজতে রাখার ভিত্তিতে স্বীকারোক্তি নেওয়ার বিষয়ে বলেছেন।উল্লিখিত পরিস্থিতি মিলিয়ে বিবেচনা করলে তাঁদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিগুলো স্বতঃস্ফূর্ত প্রকৃতির বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ সৃষ্টি করে।স্বীকারোক্তিগুলো বিশ্বাসযোগ্যতার বিচারে টেকে না।

নতুন করে তদন্তে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার

রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন,হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে কোনো দুর্বলতা ও বেআইনি কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি,শুধু পর্যবেক্ষণের বিষয় ছাড়া।

রায়ে আপিল বিভাগ বলেন,প্রত্যাহার ও সংশোধন সাপেক্ষে পর্যবেক্ষণসহ সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করা হলো।যাঁরা আপিল করেননি,তাঁদের ক্ষেত্রসহ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের কার্যকর অংশ বহাল রাখা হলো।

হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল,ন্যায়বিচারের জন্য এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে তদন্ত হওয়া দরকার,যা এ মামলার ক্ষেত্রে এখনো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এ মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত। আপিল বিভাগ বলেছেন,হাইকোর্টের রায়ের এই অংশটুকু প্রত্যাহার করা হলো।

পর্যবেক্ষণের আলোকে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছিল হাইকোর্টের রায়ে।আপিল বিভাগ বলেছেন,এই অংশটুকু বাতিল করা হলো।

মামলার পূর্বাপর

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। এতে ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার এই ঘটনায় তখন মামলা হয়েছিল মতিঝিল থানায়।মামলার তদন্ত নিয়ে তখন নানা বিতর্ক উঠেছিল। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলার তদন্ত নতুনভাবে শুরু করে সিআইডি।সংস্থাটি ২২ জনকে আসামি করে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) অধিকতর তদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ মামলার রায় দেন।রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর,সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।আরও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

এরপর হাইকোর্টে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন),আপিল,জেল আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর শুনানি হয়।পরে গত বছরের ১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। এতে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল করা হয়।ফলে মামলা থেকে সবাই খালাস পান।

গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে।চলতি বছরের ১ জুন লিভ টু আপিল (বিস্ফোরক মামলায়) মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ।এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।এই আপিলের ওপর গত ২১ আগস্ট শুনানি শেষ হয়।আজ আপিল খারিজ করে রায় দেন আপিল বিভাগ।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্যাহ আল মাহমুদ শুনানি করেন।তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবু সাদাত মো. সায়েম ভূঞা ও সাদিয়া আফরিন।আসামিপক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন।

আরও খবর

Sponsered content