শিক্ষা

সব বাধা পেরিয়ে তমিজ উদ্দিন এখন বিসিএস ক্যাডার

  প্রতিনিধি ২৮ আগস্ট ২০২৩ , ৫:২৬:৫০ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।দিনাজপুরের বীরগঞ্জের মো. সইমুদ্দিন ও মোছা. তহমিনা বেগম দম্পতির বড় সন্তান মো. তমিজ উদ্দিন।মেধাবী হলেও টানাপোড়েনের সংসারে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার শঙ্কায় থাকতে হতো।

মাধ্যমিকের পর সেই শঙ্কা অনেকটা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল।পড়াশোনা ছেড়ে তাঁকে গার্মেন্টসে যোগ দিতে হয়।কিন্তু থেমে যাননি তমিজ।সব বাধা পেরিয়ে তিনি এখন বিসিএস ক্যাডার।সর্বশেষ ৪১তম বিসিএসে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) তাঁকে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছে।

ভীষণ কোনো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সাফল্য অর্জনের কত গল্পই তো শোনা যায়।কত কত মানুষের জয়ের গাথা ঠাঁই পায় নানা বইয়ের পাতায়।কিন্তু যে অর্জন করে সেই জানে,বাধা পেরোতে কতটা দম লাগে।মো. তমিজ উদ্দিনের সে দম আছে।আছে যে,তা বলবার জন্য তাঁর পথটির দিকে তাকালেই চলে। গার্মেন্টসে কাজ করতে করতে পড়াশোনা, আর সেই পাঠ চুকিয়ে শেষে এই সময়ে সবার আরাধ্য বিসিএস ক্যাডার হওয়া তো মুখের কথা নয়।

এই আনন্দের ক্ষণে স্মরণ করেছেন তমিজ।তিনি বলেন, জীবনে দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে আল্লাহর অশেষ রহমতে আজকে আমি ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। আল্লাহর অশেষ রহমত,বাবা-মায়ের দোয়া,শিক্ষক এবং কিছু ফেরেশতাতূল্য মানুষের সহযোগিতায় এত দূর আসা সম্ভব হয়েছে।

তমিজের ভাষ্য,দরিদ্র দিনমজুর বাবার সংসারে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ার একটা ভয়ে থাকতেন। কিন্তু ভালো ফলাফল,বৃত্তি ও স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতায় এসএসসি পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয়নি।২০১৩ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তাঁর জীবনে নতুন করে সংগ্রাম শুরু হয়।

এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ+ পান।সাথে বৃত্তি।এরপর তাঁর বন্ধুরা সবাই যখন বিভিন্ন নামী কলেজে ভর্তি হচ্ছিলেন,তখন অর্থাভাবে তাঁকে ভর্তি হতে হয় বাড়ির কাছে খানসামা ডিগ্রি কলেজে।বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হন।তবে এক মাস না যেতেই বুঝতে আর বাকি থাকে না যে,তাঁর বাবার পক্ষে এত টিউশন ফি দেওয়া সম্ভব না।

ঠিক ওই সময়েই গ্রামের কিছু নেতার চাপে জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে তমিজের পরিবার বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য হয়।এতে তাঁর পড়ালেখার স্বপ্ন প্রায় শেষের পথে চলে যায়। তবুও স্বপ্নটাকে কিছুটা জিইয়ে রাখতে তমিজ কলেজে গিয়ে বিভাগ পরিবর্তন করে মানবিক বিভাগ নিয়ে সেই দিনই ঢাকায় চলে যান।

তমিজ বলেন,২০১৩ সালের আগস্টে গার্মেন্টসে কাটিং সেকশনে কাজ নিই।শুরু হয় আমার অন্য রকম একটা জগৎ। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা বা কোনোদিন রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ।এভাবেই চলতে থাকে।ওই সময় প্রায় রাতেই কান্না করতাম।আর সৃষ্টিকর্তার কাছে নালিশ করতাম,আমার ভাগ্যে যদি এটাই রেখেছ,তবে এসএসসিতে এত ভালো ফলাফল কেন?

এর পর ২০১৪ সালের নভেম্বরে কলেজের টেস্ট পরীক্ষা হয়। কলেজের টেস্ট পরীক্ষার আগে সুযোগ বুঝে গার্মেন্টসের বসকে সব বলেন তমিজ।তিনি সব শুনে তমিজকে গ্রামে গিয়ে পরীক্ষা দিতে বলেন।

সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তমিজ বলেন,কিন্তু আমার চাকরি হারানোর ভয় ছিল।তাই তাঁর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিই যে,আমাকে পরীক্ষার পরে আবার কাজে নিতে হবে।তিনি ভালো মানুষ ছিলেন।হেসে বলেন, “তোমার জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা।” ভরসা পেয়ে ২০১৪ সালের অক্টোবরে টেস্ট পরীক্ষার এক মাস আগে গ্রামে চলে যাই।মন দিয়ে পড়াশোনা করি।টেস্ট পরীক্ষার ফলাফলে আমি তৃতীয় হই। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।আরও বেশি পরিশ্রম করি। বোর্ড পরীক্ষায় এ+সহ আবারও বৃত্তি পাই।’

বৃত্তি তো মিলল।কিন্তু অভাব তো যায় না।তমিজ বলছেন, ‘ভেবেছিলাম ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে আবার গার্মেন্টসে চলে যাব। কিন্তু আমার বন্ধু জাফর,বেলাল,গণির মাধ্যমে এসব কথা জানতে পেরে বোর্ড পরীক্ষা চলাকালীন আমার কাছে ছুটে আসেন ঠাকুরগাঁও সদরের সহকারী শিক্ষা অফিসার মো. মিলন ইসলাম স্যার,মো. সোহেল রানা ভাই, মো. এনাম ভাই।পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা শেষে আমাকে বিভিন্নভাবে সাহস যোগান তাঁরা।পরীক্ষার পর ওনারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেন।’

তমিজ বলেন,মনে মনে একটাই সংকল্প ছিল ভর্তি হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই হব,অন্য কোথাও না।কারণ,সেখানে পড়লে টিউশনি করে চলা যাবে।সে সুযোগ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব সীমিত।ভর্তি পরীক্ষা দিই। ২০১৫-১৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই।মাস্টারদা’ সূর্যসেন আবাসিক হলে এটাচ পড়ে। আমার শিক্ষক ও আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় ভর্তি হই।এর পর ভীষণ আর্থিক সমস্যায় পড়ে যাই।তখন মো. ফেরদাউস হাসান ভাই টিউশনির ব্যবস্থা করে দেন।’

কঠিন সেই সময় যেন তমিজের চোখের সামনে। দৃশ্যের পর দৃশ্যে যেন তিনি নিজেকেই দেখছেন,নিজের লড়াইকে দেখছেন। আর বলে চলছেন, ‘শুরু হয় আমার টিউশন জীবন!১টা থেকে ২টা, ২টা থেকে ৪টা টিউশনি করি! এভাবে পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনির টাকা দিয়ে চলি, বাসায়ও কিছু পাঠাই।এর পর আর আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি।অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ২০১৯ সালে স্নাতক ও ২০২০ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন হয়।করোনাকালে বাড়ি গিয়ে নিষ্ক্রিয় না থেকে অনলাইনে টিউশনি চালিয়ে যাই।এর মধ্যে ৪১তম বিসিএস-এ আবেদন করি।এটাই আমার প্রথম বিসিএস ছিল।’

আবেদন তো হলো।আরও অনেকেই করেছেন আবেদন। তমিজ খুব ভালো করে জানেন এই সময়ে বিসিএস শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের কতটা আরাধ্য।ফলে আবেদন মানেই যে চাকরি নয়,তা তমিজ জানেন।সাথে এও জানেন বিসিএস ক্যাডার হতে হলে এক দীর্ঘ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।কিন্তু এর মাঝের সময়টা চলবে কী করে? ফলে আবার ঢাকায় তমিজ। কারণ,মাঝের এই সময়টার জন্য টিউশনিই যে শুধু ভরসা।

তমিজ বলছেন,করোনার পর অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে ঢাকায় যাই।তখনো হল বন্ধ।মেসে থেকে সরাসরি টিউশনি শুরু করি।ওই সময় প্রায় দুপুর ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টিউশনি করিয়েছি।বাকি সময়টুকু চাকরির প্রস্তুতি। ২০২১ সালের মার্চ মাসে ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিই। উত্তীর্ণ হই।তারপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা হয়।সেখানেও উত্তীর্ণ হই।’

এ পুরো সময়টায় তমিজ কিন্তু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন না।দারিদ্র্য,পরিবারের প্রতি দায়বোধ-এ সবই তাঁকে ছুটিয়ে বেড়িয়েছে।নিজের তৈরি পথে চলার জন্য হাত ধরে নিয়ে আসেন ছোট ভাইকে।তমিজের ভাষ্যে, ‘এ সময় ছোট ভাই রাজুকে ঢাকায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনায় সাহায্য করি।খরচ বেড়ে যায়।টিউশনিও বাড়াতে হয়। জমানো কিছু টাকা ছিল সেটাসহ বাড়ি থেকেও কিছু নিয়ে ওর জন্য খরচ করি।সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়।পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে তাকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি করাই।সে এখন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।’

যুক্ত হতে থাকে সাফল্যের পালক।এ সময়েই ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণ হন তমিজ।লিখিত পরীক্ষাও দেন। ৪৩ এর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হন। ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিতেও উত্তীর্ণ হন।মাঝে গতানুগতিক টিউশন জীবনে কিছুটা ছেদ পড়ে।প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি হয় তমিজের।চলতি বছরের জানুয়ারিতে বীরগঞ্জের ১ নম্বর শিবরামপুর ইউনিয়নের মুরারীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন।এখন সেখানেই শিক্ষকতা করছেন।এর পর চলতি বছরের জুনে ৪১তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন তমিজ।চূড়ান্ত ফলাফলে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।

কিন্তু এই সাফল্য তমিজকে আরও বেশি অতীত মনে করিয়ে দিচ্ছে।আরও বেশি করে তাঁর মনে পড়ছে সেইসব মানুষদের, যারা তাঁকে নানা বাধা ডিঙোতে সহায়তা করেছেন।তিনি চান, একদিন তিনিও অন্যদের সহায় হয়ে উঠতে পারবেন। তমিজ বলেন,এ পর্যন্ত আসার ক্ষেত্রে যারা আমাকে আর্থিক, মানসিকভাবে সাহস যুগিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।আমি সততার সাথে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে চাই এবং সমাজে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব।’

আরও খবর

Sponsered content