সারাদেশ

বরিশাল শিল্প কলা একাডেমীতে দুদকের গনশুনানি চলাকালে অদূরে ভূমি অফিসে ঘুষের দর-কষাকষি

  প্রতিনিধি ১৯ জুন ২০২৩ , ৪:৪০:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ

বরিশাল জেলা প্রতিনিধি।।দুর্নীতি দমনে যখন বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে চলছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের গণশুনানি।সেই মুহূর্তে আধা কিলোমিটার দূরত্বে নগরীর পোর্ট রোডের ভূমি অফিসে ঘুষের দর-কষাকষি করছিলেন সেবাগ্রহীতারা।

রবিবার (১৮ জুন) সকাল সাড়ে ৯টায় ভূমি-সংক্রান্ত নাম ভুলজনিত মিসকেস নিয়ে একজন সেবাপ্রত্যাশীকে অনুসরণ করেন এই প্রতিবেদক।

দেখা গেছে,প্রথমে সেবাপ্রত্যাশী এক বৃদ্ধ ভূমি অফিসের নিচতলায় প্রবেশপথের বাঁ পাশের তার কাজের জন্য খোঁজ নেন।এরপর দ্বিতীয় তলায় ১০৭ নম্বর কক্ষে গেলে সেখানে অফিস সহকারী আতিকুল রহমান খান তাকে বলেন, সোমবার ও বুধবার শুনানি হবে।একজন উকিল ধরে তার সঙ্গে পরামর্শ করে আসুন।

সেবাগ্রহীতা বলেন,আমার সবকিছু প্রস্তুত আছে।একটু দেখিয়ে দিন।এ কথায় রেগে গিয়ে অফিস সহকারী বললেন,যখন সব বোঝেন তো আপনারাই করে নিন।এরপর অফিস সহকারী অন্য রুমের দিকে চলে যান।সেখান থেকে বৃদ্ধ ১০৯ নম্বর কক্ষে যান।সেখানে লেখা আছে,এনামুল হক কানুনগো।

রুমের ভেতরে দীর্ঘ জট।ভিড়ের চাপে প্রবেশ অসম্ভব প্রায়। আর চারপাশে মানুষের মুখে গুঞ্জন,টাকা ছাড়া কি কোনও কথা নেই এদের মুখে?ভেতর থেকে পরিষ্কার আওয়াজ এলো, সার্ভেয়ার রিয়াজের পকেটে কিছু দিন,তাহলেই হয়ে যাবে।

এবার বৃদ্ধ ১১০ নম্বর সার্ভেয়ার ও সহকারী কানুনগোর কক্ষে যান।এরপর তার সমস্যা জানালেন উপস্থিত অফিস সহায়ক দেলোয়ারের কাছে।কাগজপত্র দেখে সব ঠিক আছে জানিয়ে বললেন,কোট ফি বসিয়ে জমা দিয়ে যান।কোট ফি লাগিয়ে দেলোয়ার কক্ষে যাওয়ার পর দেখা যায় তিনি ভীষণ ব্যস্ত। হাতের কাজ সামলাতে সামলাতে বললেন,কিছু খরচ দিতে হবে।বোঝেনই তো ফোন,চিঠি ইত্যাদি চালাচালি করতে হবে।

সেবাগ্রহীতা বৃদ্ধ পকেটে থেকে ৫০০ টাকা বের করে দিয়ে বলেন,আমি গরিব মানুষ,কোনও আয়রোজগার নেই,এই টাকাটা রাখুন।সঙ্গে সঙ্গে দেলোয়ার রেগে গিয়ে বলেন, জমিজমার বিষয়ে এসে টাকা নাই বললে হবে না।আপনার কাগজপত্র নিয়ে যান।বাধ্য হয়ে বয়োবৃদ্ধ তার পকেটের শেষ সম্বল আরও ৫০০ টাকা বের করে দিলে বললেন, মিসকেসের একটা কাগজ রিসিভ কপি দিন প্লিজ।আবারও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে টাকা ধরলেন না অফিস সহায়ক। উল্টো কাগজপত্র ফাইল থেকে বের করে বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন,পোস্ট অফিসে যান,রেজিস্ট্রেশন করে পাঠান। আপনার টাকা-কাগজ কোনোটাই নেবো না।

এ সময় চেয়ারে বসা আরেক বৃদ্ধ মিসকেস করতে আসা সেবাগ্রহীতা তাকে বললেন,সরি বলে টাকাটা রেখে চলে যান। পরে তিনি সরি বলে টাকা ও কাগজটা টেবিলে রেখে চলে যান।টাকা গুনে পকেটে ভরেন অফিস সহায়ক দেলোয়ার। এভাবেই সবার কাছ থেকে টাকা নেন দেলোয়ার।

এমন অবস্থা দায়িত্বরত অন্য সবার কক্ষে।সেখানে ঘুষ বিষয়টা আরও ওপেন সিক্রেট।আর এই ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ভূমি প্রশাসনের পিয়ন থেকে সার্ভেয়ার,কানুনগোসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই।

এ বিষয়ে জানালে বরিশাল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তরিকুল ইসলাম বিষয়টি শুনে লজ্জিত হন। তিনি বলেন,এই মানুষগুলোর কারণে আজ আমাদের এতটা অবনতি।বিষয়টি খতিয়ে এর সঙ্গে যারা জড়িত,তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেন এ ভূমি কর্মকর্তা।

এদিকে এ ঘটনা যখন চলছিল,তখন জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে দুর্নীতিবিরোধী গণশুনানি অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান।ওই শুনানিতে উপস্থিত বেশির ভাগ সেবাগ্রহীতার অভিযোগ ছিল ভূমি অফিসের বিরুদ্ধে।এ সময় ভূমি কর্মকর্তাকে সেবাগ্রহীতাদের সমস্যা সমাধানে নির্দেশ দেন তিনি।এমনকি সময়ও বেঁধে দেন তিনি।

দুদকের কমিশনার তার বক্তৃতায় বলেন,দুর্নীতি সমাজ ও অর্থনীতির বড় অন্তরায়।আমাদের কল্যাণরাষ্ট্র গঠন করতে হলে দুর্নীতি রুখতে হবে।আইন করে দুর্নীতি রোধ করা যাবে না। আমাদের মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে।লোভ-লালসা পরিহার করতে হবে।

জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেনের সভাপতিত্বে গণশুনানি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান,পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম,দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন,পুলিশ সুপার ওয়াহেদুল ইসলাম,দুদকের বরিশাল আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল গাফফার ও বরিশাল জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি রাবেয়া খাতুনসহ অন্যরা।

এ ব্যাপারে টিআইবির সভাপতি অধ্যাপক জাহিদ হোসেন বলেন,গণশুনানি প্রদর্শনী ছাড়া কিছুই নয়।এ গণশুনানিতে সেবাগ্রহীতার কোনও লাভ হবে না।যতক্ষণ না প্রতিটি অফিসের কর্মকর্তারা মানবিক দিক বিবেচনা করে দুর্নীতির বাইরে থেকে সেবাগ্রহীতার কাজটি সম্পন্ন করবেন,ততক্ষণ এ দুর্নীতি বন্ধ হবে না।সেবাগ্রহীতারা প্রদর্শনী চায় না,তারা চায় দুর্নীতিমুক্ত সেবা।

আরও খবর

Sponsered content