ব্যবসা ও বাণিজ্য সংবাদ

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশ এককভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার

  প্রতিনিধি ১১ জুন ২০২৩ , ৮:৩৪:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।তৈরি পোশাক আমদানির যে পরিসংখ্যান যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্স বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে,তা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের কপালে ভাঁজ ফেলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশ এককভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার।গত বছর সেখানে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা।কোভিড মহামারির প্রায় শেষ পর্যায়ে ২০২২ সালে ওই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।কিন্তু এই সুসময় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে,চলতি বছরের প্রথম চার মাসে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পাশাক আমদানি ২২ শতাংশ কমিয়েছে।বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এ ধরনের ঘটনার প্রথম শিকার হয় চীন।এবারও ঠিক তাই হয়েছে। তাদের রপ্তানি কমেছে ৩২ শতাংশের বেশি।কিন্তু একই সঙ্গে মার খেয়েছে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিও।জানুয়ারি–এপ্রিল এই চার মাসে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের রপ্তানি হয়েছে ২৭০ কোটি ডলারের।ঠিক এক বছর আগে একই সময়ে রপ্তানি ছিল ৩২৮ কোটি ডলারের পোশাক।সেই হিসাবে রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার তাই–ই নয়,দেশটি বাংলাদেশের রপ্তানিরও সবচেয়ে বড় বাজার।খারাপ ধারাটি হলো বেশ কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমছে।গত বছরের শেষ প্রান্তিক,অর্থাৎ অক্টোবর–ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় তার পরের প্রান্তিকে রপ্তানি আয় কমে গেছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের অক্টোবর–ডিসেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় ছিল ১৯৩ কোটি ডলার,যা পরের প্রান্তিকে নেমে আসে ১৬০ কোটি ডলারে। ২০২২ সালের জানুয়ারি–মার্চ সময়ে এই আয় ছিল ২১৩ কোটি ডলার।

* চলতি বছরের জানুয়ারি–এপ্রিল এই চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি হয়েছে ২৭০ কোটি ডলারের। * গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৩২৮ কোটি ডলারের পোশাক।

মার্কিন বাজারে রপ্তানির এই পতনের জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতিকে।মহামারির পর মার্কিন অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়ে।এরপর রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানির সংকট এবং পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর চেষ্টা করে।মার্কিন ভোক্তাগোষ্ঠী ধার করে চলতে অভ্যস্ত।তাদের জন্য ধার করা ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। তবে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে,সেই সময়ের বিলম্বিত অভিঘাত হয়তো এখন দেখা দিচ্ছে।

২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে ফেডারেল রিজার্ভ তাদের সব বৈঠকে নীতিসুদ হার বাড়িয়েছে।এর ফলও পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি এখন সাড়ে ৪ শতাংশের ঘরে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে ফেডের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। চলতি সপ্তাহেই ফেডের আরেকটি বৈঠক হবে।আর্থিক বিশ্লেষকেরা নিশ্চিত নন যে সুদের হার আরও এক দফা বাড়ানো হবে কি না।তবে এবার বাড়ানো না হলেও চলতি বছরেই যে বাড়ানো হবে,সে ব্যাপারে বিশ্লেষকেরা মোটামুটি একমত।ফেডের লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের ঘরে নিয়ে আসা।সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার উঁচুতে ধরে রাখার মানে হলো ভোক্তাদের ঋণ করা ব্যয়বহুল থেকেই যাবে।

সুতরাং যে মূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের চাহিদা কমেছে,সেই মূল্যস্ফীতি যদি দ্রুত না কমে,তাহলে তা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য দুঃসংবাদ।কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা এখানেই শেষ হচ্ছে না। চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানি এখন কমে গেলেও প্রশ্ন উঠছে, চাহিদা বাড়লে কি বাংলাদেশ রপ্তানি বাড়াতে পারবে? সংকট বলি কিংবা বিপর্যয়—পণ্য উৎপাদনে যে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে,তার সমাধান কীভাবে হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বিদ্যুতের হাহাকার,গ্যাসের সংকট,ব্যাংকে ডলার ঘাটতি—বাংলাদেশের শিল্প খাত সম্ভবত এখন বড় দুঃসময় পার করছে।জুলাই থেকে এপ্রিল,এই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৫৬ শতাংশ।আর কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২৯ শতাংশ।মূলত ডলার–সংকটের কারণেই উৎপাদনের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের আমদানি কমেছে।সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যোগ যে উপাদানের,সেই কাঁচামালের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে।সুতরাং কাঁচামাল আমদানির মোট পরিমাণ যদি ঠিক থাকে, তাহলে হয়তো এ ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা কম। কিন্তু দুশ্চিন্তা থাকবে সরবরাহের দিক থেকে।

তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের জন্য সম্ভবত স্বস্তির বিষয় যে যুক্তরাষ্ট্রে কেবল বাংলাদেশের একার রপ্তানি কমেনি।বরং ওই বাজারে বাংলাদেশের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী,সেই ভিয়েতনাম,ইন্দোনেশিয়া,ভারতসহ প্রায় সব দেশের রপ্তানিই কমেছে।চীনের কমেছে সবচেয়ে বেশি। সুতরাং রপ্তানির এই ঘাটতি মূলত চাহিদার সংকোচনের কারণে। কিন্তু চাহিদার বিষয়টি ঠিক হয়ে গেলে বাংলাদেশ কি সরবরাহ বাড়াতে পারবে?প্রশ্ন এখন সেটাই। ‘সাপ্লাই সাইড’ অর্থাৎ সরবরাহ বাড়ানোর পথে যেসব বাধা আছে,সেসব বাধা দূর করতে কী করা হচ্ছে? ডলার–সংকটের কারণে কয়লা কিংবা তরল গ্যাস আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে।সুতরাং যে জ্বালানিসংকট শিল্পকে অনেকটা পঙ্গু করে রেখেছে,তা থেকে কত দ্রুত মুক্তি আসবে? যন্ত্রপাতি–কাঁচামাল আনার জন্য ডলারের ব্যবস্থা কি করা যাবে? সমস্যা হয়তো আরও আছে। তবে অন্ততপক্ষে নীতিনির্ধারকেরা এসব বিষয়ে যত দ্রুত নজর দেবেন, তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত সবার কপালের ভাঁজ তত দ্রুত দূর হবে।

আরও খবর

Sponsered content