অর্থনীতি

টাকা নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি,ঋণের বোঝাও ধরিয়ে দিয়েছে-এমটিএফই

  প্রতিনিধি ২১ আগস্ট ২০২৩ , ২:৪২:২০ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে বন্ধ হয়েছে এমটিএফই নামক একটি প্রতিষ্ঠান।দুবাই ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করতো।ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিল।তবে এই ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের বলে অভিমত সাইবার বিশ্লেষকদের।

ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে অনলাইনে বিনিয়োগ করে কম সময়ে অধিক মুনাফার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার অন্যতম প্লাটফর্মের মধ্যে রিপটন কয়েন,সিজি ট্রেড ও এমটিএফই অন্যতম অ্যাপ।বাংলাদেশে এগুলোর কোনটিরই বৈধ কোন নিজস্ব অফিস নেই।আছে শুধু এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি। এসব প্রতিনিধি কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া বড় একটি নির্দিষ্ট মুনাফার নিয়ে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের কম সময়ে অধিক মুনাফার আকর্ষণীয় লোভ দেখায়। এরপর কোম্পানিতে নিজস্ব অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে অর্থ বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে আসছে।

বিদেশ থেকে পরিচালিত এমটিএফই অ্যাপে প্রায় শতকোটি টাকা খোয়ালেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় দুই হাজার মানুষ।

বিনিয়োগকারীরা জানায়,রাতারাতি কোটিপতি হওয়ায় আশায় কুমারখালীসহ কুষ্টিয়া জেলায় অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ প্রায় ৮ হাজার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিলেন এমটিএফই অ্যাপসে।গত শুক্রবার থেকে অ্যাপসটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।এটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করত।যা দেশের আইনে অবৈধ।

জানা গেছে,কুমারখালীতে এমটিএফইর মূলহোতা পৌরসভার বাটিকামারা মধ্যপাড়ার মৃত মসলেম উদ্দিনের ছেলে মো. মিজানুর রহমান।তিনি ফেমাস ফুলকুঁড়ি বিদ্যালয়ের পরিচালক। এবং তার প্রধান সহকারী ছিলেন পৌরসভার ঝাউতলা এলাকার মৃত তোফাজ্জেলের ছেলে মো. মাসুম আলী।তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন।চাকরি করতেন ঢাকা হেড কোয়াটারের আইটি সেক্টরে।সম্প্রতি তিনি পুলিশের চাকরি ছেড়ে এমটিএফইসহ বেশকিছু অনলাইন ব্যবসা শুরু করেন।

কুমারখালী বাসস্টান্ড সংলগ্ন সিঙ্গার প্লাজার দোতালায় অফিস করে প্রায় দেড় বছর ধরে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন।মাসুম ও মিজানের মাধ্যমে উপজেলায় প্রায় দুই হাজার মানুষ বিনিয়োগ করেছে। প্রত্যেকে ৮ হাজার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেন।

আরও জানা গেছে,কারোর মাধ্যমে ১০০ জন বা দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে কোম্পানি তাকে কান্ট্রি অফ অপারেশন সার্ভিস (সিইও) পদমর্যাদা দেয়।মিজানুর কুষ্টিয়ার এমটিএফইর প্রধান সিইও পদে ছিলেন। তার পরের স্থান মাসুম আলীর। মাসুমের মা রেখা খাতুনও আছে সিইও পদে।গত ১১ আগস্ট মিজানুর ও মাসুম ওমরা হজে গিয়েছেন।এরপর থেকেই অ্যাপসটিতে নানা সমস্যা ও কমিশন কমে যায়।আর গত শুক্রবার (১৮ আগস্ট) থেকে অ্যাপস বন্ধ হয়ে গেছে।

শনিবার (১৯ আগস্ট) বিকেলে পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ঝাউতলা এলাকায় সিইও মাসুম আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে,মাসুমের ঘরে এমটিএফইর বিভিন্ন জনের হিসাবের খাতা ও ফাইলপত্র।সৌদিআরবে ওমরা হজে গেছেন মাসুম আলী।

এ সময় তার মা রেখা খাতুন বলেন,মাসুম পুলিশের চাকরি করত।চাকরি ভাল না লাগায় দেড় বছর আগে ছেড়ে দেয় এবং এমটিএফই ও বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসা শুরু করে।তিনি নিজেও ছাগল বিক্রি করে ছেলের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন।তিনিও সিইও পদে আছেন।’

বাংলাদেশে এ ধরনের অ্যাপ চালানোর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো অনুমোদন ছিল না।তাই তারা যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোনো তথ্য দেয় না।তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য আনে না।ফলে প্রতারণার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কোনো তথ্য নেই।

তিনি আরও বলেন,তার ছেলের দোষ নেই।মানুষ রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার লোভে বিনিয়োগ করেছে। তার ছেলে সৌদিআরব হজে গেছেন।’

প্রধান সিইও মিজানুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে জানা যায় তিনিও হজে গেছেন। বাড়িতে আছেন তার স্ত্রী সুমি খাতুন। তবে তিনি এসব নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আকিবুল ইসলাম বলেন,ফেসবুকের মাধ্যমে এমপিএফই সম্বন্ধে জানতে পেরেছি।তবে এখন পর্যন্ত থানায় কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।’

এদিকে বর্তমানে বিনিয়োগকারী প্রতিটি অ্যাকাউন্ট থেকে ওই অ্যাপটি আরও অর্থ পাবে বলে উল্টো ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়েছে।অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থ উল্লেখ করে তার আগে বিয়োগ (মাইনাস) চিহ্ন দিয়ে রেখেছে।এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন,তারা এখন সর্বশান্ত হয়ে চোখে সরিষার ফুল দেখছেন।

তবে বিনিয়োগকারীরা পথে বসলেও কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন এলাকাভিত্তিক ওই কোম্পানির সিইও নামক কতিপয় ব্যক্তি,যাদের দেখানো প্রলোভনে পড়ে সকল শ্রেণির মানুষ অধিক লাভের স্বপ্ন বুনে এই অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিলেন।

জানা গেছে, বিদেশি অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) একটি অনলাইন ট্রেডিংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অ্যাপটি চালু থাকা অবস্থায় অ্যাকাউন্ট চালু করার জন্য সর্বনিম্ন ২৬ ডলারের সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হতো। সেই টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন পাওয়া যাবে শতকরা হিসেবে নির্দিষ্ট মুনাফা। যার অ্যাকাউন্ট যত বেশি অর্থ থাকবে,সে তত বেশি মুনাফা পাবেন।এমন সব লোভনীয় সময়পযোগী প্রলোভন দেখিয়ে প্রচারণা করছিল কিছু যুবক। আর এতেই হুমড়ি খেয়ে অ্যাপটিতে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

কোন কাজ ছাড়াই মুনাফা পাওয়ার আশায় কেউ জমি বন্ধক রেখে,কেউবা জমানো টাকা,কেউবা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ ও ধারদেনা করে লাখ লাখ টাকা এমটিএফই অ্যাপের কয়েজন সিইও নামক ব্যক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিলেন। নিযুক্ত সিইওরা কাউকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিলে কোম্পানি থেকে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দেওয়া হতো।পাশাপাশি তার মাধ্যমে যতগুলো ব্যক্তি বিনিয়োগ করবেন তাদের সবার কাছ থেকে ওই সিইও একটি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা পেতেন।

ভুক্তভোগীরা জানান,এই অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলার পর বিনোযোগ করা টাকার ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা হতো।হঠাৎ করেই অ্যাকাউন্ট থেকে তারা টাকা উঠাতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্টে কোন ডলার নেই।উল্টো তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কোম্পানি আরও অর্থ পাবে বলে মাইনাস চিহ্ন দেওয়া হয়েছে।প্রতারণা করে তাদের টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে এমটিএফই।লাভের আশায় এসে উল্টো ঋণের বোঝাও ধরিয়ে দিয়েছে তারা।

এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন,তারা এখন সর্বশান্ত হয়ে পথে বসেছে। তবে প্রথম দিকে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন এবং যারা চতুর- তাদের অনেকেই মুনাফা তুলে নিয়েছেন।আর যারা বেশি মুনাফার আশায় ছিলেন বা প্রাপ্ত মুনাফার অর্থ তুলে নিতে পারেননি, তারা সর্বশান্ত হয়েছেন।

রাণীনগর উপজেলার বাজার এলাকার নিশাদ ইসলাম আকাশ জানান,তিনি মূলত অনলাইনে কাজ করেন।এই বিষয়টি জানার পর সম্প্রতি ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন এমটিএফইতে।তার দেখাদেখি তার আরও চারজন সহকর্মী একই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন।অন্য সবার মতো তাদের অর্থও হাতিয়ে নিয়েছে ওই কোম্পানি।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে নওগাঁ শহরের এক ভুক্তভোগী বলেন,একটু লাভের আশায় ধার করে ১ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছিলাম।কিছুদিন তারা ওই টাকার উপর লাভও দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কিছুদিন আগে অ্যাপটি থেকে টাকা উঠানো বন্ধ করে দেয়।এখন শুনছি তারা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।এখন ধারের টাকা পরিশোধ করবো কীভাবে সেই চিন্তায় আছি।

তিনি আরও বলেন,লাভের আশায় এসে উল্টো ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়েছে এমটিএফই।সব ডলার কেটে নিয়ে উল্টো একাউন্টে বিশাল অংকের মাইনাস ডলার ধরিয়ে দিয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা পরিশোধ করতে বলেছে। ২৪ ঘণ্টা পর আজকে আবার তাদের অ্যাপে নোটিশ দিচ্ছে যে, ‘২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে আপনি ঋণ পরিশোধ করেননি।আপনাকে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো।এর মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে আপনাকে আইনি নোটিশ পাঠানো হবে।অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান বলেন,এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও কেউ কোন অভিযাগ করেনি। কোন ভুক্তভোগী অভিয়োগ করলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ব্যাংক কী বলছে?
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, অনেকদিন থেকেই আমরা এই প্ল্যাটফর্মটি নিয়ে সতর্কতা দিয়ে আসছিলাম।কিন্তু মানুষ লোভের ফাঁদে পড়ে এখানে টাকা দিচ্ছিল।কিছু দিন আগে জানতে পারি,এখানে যারা টাকা দিচ্ছিলেন তারা আর টাকা উঠাতে পারছিলেন না।এমটিএফই তাদের সিস্টেম বন্ধ করে দিয়েছে।’

বাংলাদেশে এ ধরনের অ্যাপ চালানোর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো অনুমোদন ছিল না।তাই তারা যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোনো তথ্য দেয় না।তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য আনে না।ফলে প্রতারণার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কোনো তথ্য নেই।

আরও খবর

Sponsered content