প্রতিনিধি ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১:০৬:০২ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের প্রয়োজনে দলীয় নমিনেশনের ক্ষেত্রে প্রার্থী পরিবর্তনের আভাস দিয়ে বলেছেন, ‘যে কোনো নির্বাচনে নমিনেশনে পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
ক্ষেত্রমতো আমরা অবশ্যই যাচাই করে দেখব, কার জেতার সম্ভাবনা আছে, কার নেই। কে ভোট পাবে, না পাবে। আর ভোট পেলে সে জিতবে কি না, সবকিছু বিবেচনা করে নির্বাচনে নমিনেশন দেওয়া হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি আছে। সময় যত যাবে ততই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’
গতকাল বুধবার বিকালে গণভবনে ভারত সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী ভারত সফরে অর্জিত সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ১৪ দল নাকি মহাজোটগতভাবে করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়টা তো সময় আসলে বলতে পারব। আমরা ১৪ দল করেছি। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছি। গত জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জাপা) আলাদাভাবে নির্বাচন করেছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা ছিল। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে কে কোথায় থাকবে তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনে যারা সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিল তারা (১৪ দল) আমাদের সঙ্গে থাকবে। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আর আমাদের সঙ্গে কে থাকবে না থাকবে, নতুন জোট হবে বা কি হবে হোক—অসুবিধা তো নেই। আর আওয়ামী লীগ উদারভাবে কাজ করে, আওয়ামী লীগের দরজা খোলা।’ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই ইলেকশনে পার্টিসিপেট করুক সেটাই আমরা চাই। তবে যদি কেউ না করে সেটা যার যার দলের সিদ্ধান্ত। সে জন্য আমরা সংবিধান তো বন্ধ করে রাখতে পারি না। আমরা চাই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকবে।’
গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন দলীয় নেতারা।
জেলা পরিষদে নমিনেশন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হয়তো বেশি দিন বাঁচবেন না। বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাদের আর কষ্ট দিতে চাইনি। যাদের নমিনেশন দিয়েছি সেখানে পরিবর্তন আনিনি।’ তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন একটানা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে তো, গণতান্ত্রিক ধারাটা অব্যাহত আছে। আপনারা কিন্তু ভুলে গেছেন, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর বারবার ক্যু হচ্ছিল। একটা মিলিটারি ডিকটেটরের পর আরেকটা মিলিটারি ডিকটেটর। অথবা মিলিটারি ডিকটেটরের স্ত্রী ক্ষমতা নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে।জনগণের কী ছিল তখন? জনগণের আদৌ কোনো অধিকার ছিল? সারা রাত কারফিউ, কথা বলার অধিকার নেই। কে কখন গায়েব হয়ে যাচ্ছেন তার ঠিক নেই। এই তো ছিল বাংলাদেশের অবস্থাটা।আপনারা এখন টকশো করেন,যে যার মতো কথা বলেন। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার আগে কে এত কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন বলেন তো?’
তার সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেন, ‘মনে হয় না যে একেবারে শূন্য হাতে ফিরে এসেছি। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সব দল-মত এক থাকে। এটাই বড় কথা।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত সফরের সময় দেশটির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে সবাই খুব আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। আপনি যদি নিজে ভালো বন্ধু হন তো সবাই ভালো থাকবে।’
আওয়ামী লীগ সব সরকারের আমলে নির্যাতিত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ওপর তো সবাই চড়াও হয়েছে। সেই জিয়াউর রহমান থেকে শুরু, তার পর থেকে একের পর এক। লাশ টানতে টানতে আর আহতদের চিকিৎসা করতে করতে নাভিশ্বাস উঠেছিল আমাদের। এখন কি সেই পরিবেশ আছে? তা তো নাই। এমনকি আমার পার্টির কেউ যদি কোনো অন্যায় করে আমরা কিন্তু ছেড়ে দেই না। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলে কিছু বলব না; তা না। যে অন্যায় করবে তার বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নেব এবং নিচ্ছি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমি কখনো সহ্য করব না।’ বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কি এত সহজ ছিল? যদি সুষ্ঠুভাবে, সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে না পারতাম, যদি অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি না হতো, যদি গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত না হতো, তাহলে তো এই অর্জনটা সম্ভব হতো না। সমালোচনা যারা করবে, করুক না। করা তো ভালো। আমাদের কোনো আপত্তি নাই। আমরা শুনব। সেখান থেকে যদি ভালো কিছু আছে গ্রহণ করব।’ ভারত সফরে গিয়ে বাংলাদেশ কী পেয়েছে—সেই প্রশ্ন যারা করেন তাদের উদ্দেশ্যে পালটা প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ কী পায়নি? ভারত সফরে বাংলাদেশ কী পেল, এটা আপেক্ষিক প্রশ্ন। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে ভারত সব বিষয়েই সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এ সফরেও আমরা একেবারে শূন্য হাতে ফিরেছি, এটা বলতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যার সবদিকে ভারত। একপাশে ছোট্ট একটুখানি মিয়ানমার সীমান্ত। বাকি সীমান্ত জুড়ে বঙ্গোপসাগর, এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো—বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সব দল-মত এক থাকে।’
গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও উপস্থিত গনমাধ্যম কর্মীরা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানির আগে আগাম বার্তা দেবে ভারত
প্রধানমন্ত্রী চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি বন্ধের আগে বাংলাদেশকে আগাম বার্তা দেবে ভারত। সে অনুযায়ী সরকার পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, সফরকালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সহযোগিতা, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবারের সফরে গঙ্গার পর প্রথম বারের মতো অভিন্ন নদী কুশিয়ারা থেকে সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের আওতায় ১৫৩ কিউসেক পানি বণ্টনে আমরা একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি। এই সমঝোতা স্মারকের ফলে রহিমপুর সংযোগ খালের মাধ্যমে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে। এছাড়া পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ প্রযুক্তি, গ্রিন ইকোনমি, সুনীল অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক ও জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
স্বনামধন্যদের অর্থ পাচারের তথ্য আছে
দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থ পাচারকারী এমন অনেকের তথ্য আছে সেটা আপনারা (সাংবাদিক) লিখবেন কিনা সন্দেহ। আমি সোজা কথা বলি, অনেক স্বনামধন্যের তথ্য আমার কাছে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সামনে তাদের নাম আসবে, তবে আপনারা ছাপাবেন কিনা আমি সেটা দেখব।
ভারত থেকে কম খরচে ডিজেল আসবে
জ্বালানি সংকটের সমস্যার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আসবে। ফলে তেল পরিবহনের খরচ অনেকটা কমে যাবে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১২৬ দশমিক ৫৭ এবং ভারত অংশে ৫ কিলোমিটার পাইপলাইন ভারত সরকারের অর্থায়নে নির্মাণকাজ চলছে।
রোহিঙ্গারা বোঝা হয়ে যাচ্ছে
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের মনোভাব কী জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত এটা উপলব্ধি করে যে আমাদের এখানে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন অবস্থান একটা সংকট সৃষ্টি করছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। এটা আরও পরিবেশটাকে নষ্ট করছে। তবু আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।
ভারত সফরে নতুন দিগন্তের সূচনা
সামপ্রতিক ভারত সফরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ তিন বছর বিরতির পর আমার এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। সফরের পুরো সময়ে আমরা ভারতের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ও সৎ-প্রতিবেশী হিসেবে সমতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার লক্ষ্য করেছি। তিনি বলেন, ভারতীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে, সংবাদমাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আমি বাংলাদেশের জন্য যে প্রীতি ও সৌহার্দ লক্ষ করেছি তা সত্যিই অসাধারণ। এই প্রীতির সম্পর্ককে সুসংহত করে আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। আর এই সফরে সহযোগিতার যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করলে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক চান, ওয়ান-ইলেভেন ভুলে গেছেন?
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বিএনপির যে দাবি, তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন যারা তত্ত্বাবধায়ক বলে চিৎকার করছে, তারা ওয়ান-ইলেভেনের কথা ভুলে গেছে? ২০০৭-এর কথা ভুলে গেছে? যে কী অবস্থাটা সৃষ্টি হয়েছিল?’
‘ভাই, এক কান নাই’
একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন করার সময় তার মাইকের সাউন্ড কিছুটা কম ছিল। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর শুনতে অসুবিধা হচ্ছিল। একপর্যায় প্রশ্নকারীকে থামিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটু মাইকটা… বুঝতে পারছি না। তিনি হাসির ছলে আরও বলেন, ভাই এক কান নাই। গ্রেনেড হামলা এক কান নিয়ে নিয়েছে। একটাই আছে। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে সংবাদ সম্মেলনে হাসির রোল পড়ে যায়।