জাতীয়

২২ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পৌঁছাতে পারলাম না

  প্রতিনিধি ২৮ জুন ২০২৩ , ৪:৫৩:৫৫ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে সরকারি চাকরিজীবী মো. সুমন রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা থেকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটায় বের হন।

ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছান শ্যামলী।সেখান থেকে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে করে রাত সোয়া আটটায় তাঁর যাত্রা শুরুর কথা ছিল।কিন্তু চার ঘণ্টা দেরি করে রাত ১২টার দিকে বাস ছাড়ে।

আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সুমন বলেন, ‘ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও আসতে সাধারণত সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে।অথচ যখন বাস ছাড়ার কথা ছিল,তারপর ২২ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পৌঁছাতে পারলাম না।আমি এখন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ পার হচ্ছি। আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে।’

রাত ১২টার পর বাস ছাড়লেও যানজটের কারণে টাঙ্গাইল পার হতেই সকাল হয়ে যায় উল্লেখ করে সুমন বলেন,যারা গাড়িতে বসে আছে,তাদের কারও কারও পা ফুলে গেছে। আপনারা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতেন,আমরা কী অবস্থায় আছি।’

রাজধানীর গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,উত্তরাঞ্চলগামী গতকাল মঙ্গলবার রাতের অনেক বাসই দেরি করে ছেড়েছে।বেশ কিছু বাস মধ্যরাতে ছাড়ার কথা থাকলেও তা আজ ভোরে ছেড়ে গেছে।মূলত যানজটে বাস ঢাকায় আসতে না পারার কারণে ছাড়তে দেরি হয়েছে।তবে আজ সকাল থেকে তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলে চলাচলকারী গ্রামীণ ট্রাভেলসের কাউন্টার মাস্টার আতাউর রহমান বলেন,মঙ্গলবার রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত আমাদের ছয়টা বাস ছিল।সব কটি আজ ভোরে গেছে।১০-১২ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে।যানজটের কারণে বাস আসতে না পারায় এই দেরি হয়েছে।তবে আজ সকাল থেকে দেরি হচ্ছে না।

একই ধরনের কথা বলেন গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার আরিফুর রহমান।তিনি বলেন,গত রাত নয়টার বাস আজ ভোর পাঁচটায় ছেড়ে গেছে।গাবতলীর গরুর হাটের কারণে কল্যাণপুর থেকে যানজট।এই যানজট নবীনগর পর্যন্ত। যমুনা সেতু এলাকায়ও যানজট রয়েছে।তা ছাড়া টার্মিনাল ছাড়াও বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে রাস্তার ওপর গাড়ি রেখে যাত্রী তোলা হয়,এ কারণেও যানজট হচ্ছে।

তবে গাবতলী থেকে দক্ষিণাঞ্চলের কোনো কোনো পরিবহনের বাস ৪-৫ ঘণ্টা দেরি করে ছাড়ছে।পরিবহনগুলোর কাউন্টার থেকে জানানো হয়েছে,নবীনগর থেকে গাবতলী পর্যন্ত যানজট। এ কারণে বাস ঢাকায় প্রবেশ করতে দেরি করায় এই সমস্যা হচ্ছে।

বৃষ্টি সত্ত্বেও ট্রাক-পিকআপে যাত্রা:-যানজট ছাড়াও ঈদে বাড়ি ফেরার আজ শেষ দিনে বৃষ্টির কারণে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে বহু মানুষকে।আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হয়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে।

তাই বাড়িমুখী মানুষ কমবেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষেরা।কারণ,অনলাইনে ট্রেনের সব টিকিট ছাড়ায় শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে তা কাটা সম্ভব হয় না।দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিট কাটতে হলেও রেলওয়ের অ্যাপে নিবন্ধন থাকা লাগে।যে কারণে এবার ট্রেনে করে শ্রমজীবী মানুষ বাড়ি ফিরতে পেরেছেন কম।অন্যদিকে অর্থাভাবে বহু শ্রমজীবী মানুষ ট্রাক ও পিকআপে করে ঈদে ঢাকা ছাড়েন।রাজধানীর আমিনবাজার সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টি সত্ত্বেও বহু মানুষ ট্রাক ও পিকআপে চেপে ঢাকা ছাড়ছেন।কোনো কোনো ট্রাক পর্দা দিয়ে ঢাকা হলেও বেশির ভাগই ফাঁকাই যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে।

বেলা দুইটার দিকে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে আমিনবাজার সেতুর ওপর দাঁড়ানো একটি ট্রাকে ওঠেন মো. হাকিম নামের এক ব্যক্তি। ট্রাকের ওপর থেকে তিনি বলেন,বাস তো পাই না, ভাড়া বেশি চায়।আর এই ট্রাক ২০০ টাকা দিয়ে সিরাজগঞ্জ নিয়ে যাবে। তাই উঠলাম।’

সেই ট্রাক ঢাকায় চাল নিয়ে এসেছিল।যাওয়ার সময় সিরাজগঞ্জ ২০০ টাকা এবং রাজশাহী ৫০০ টাকা করে নিচ্ছিল।

ভাড়া বনিবনা না হওয়ায় গাড়িচালক মো. আনোয়ারুল হক ও তাঁর পরিবারের মোট ১০ জন এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বৃষ্টিতে ভিজছিলেন।তাঁদের সঙ্গে দুই শিশু,তিন নারী ও পাঁচজন পুরুষ ছিলেন।তাঁদের সঙ্গে ছাতা ছিল মাত্র একটি। দেখা যায়,সাড়ে চার বছরের শিশু রাব্বির মাথার চুল ভিজে গেছে।৭ বছরের রিমি মাথায় তোয়ালে দিয়ে টিপটিপ বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছিল।তবে সেখানে কারোরই যেন বৃষ্টির কাছ থেকে শেষ রক্ষা হচ্ছিল না।আনোয়ারুল হক বলেন,যা ভাড়া চায়,তা তো আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই একটু কমের আশায় অপেক্ষা করছি।’

মাথায় পলিথিন দিয়ে বাসের অপেক্ষায় আমিনবাজার সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. আবদুল জলিল।তিনি ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বর এলাকায় থাকেন।ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। সেই রিকশার পলিথিন নিয়েই তিনি সিরাজগঞ্জের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।

‘দাদা-দাদির বয়স হয়েছে,ওঁদের সাথে ঈদ করতে যাচ্ছি’
বৃষ্টি ও যানজটের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ঢাকা ছাড়ছেন মানুষ।আজ এলা একটার দিকে ঝুমুর আক্তারের স্বামী কাউন্টারে টিকিটের খোঁজ করছিলেন।আর ১২ বছর বয়সী ছেলে মো. হাসান ইসলামকে নিয়ে ঝুমুর বসেছিলেন গাবতলী বাস টার্মিনালের বিআরটিসির ভিজিল্যান্স টিমের সামনে।তখন কথা হয় হাসানের সঙ্গে।গ্রামে যাওয়া প্রসঙ্গে হাসান বলে,আমরা কোরবানির ঈদ বেশির ভাগ সময় ঢাকায় করি।কিন্তু দাদা-দাদির বয়স হয়েছে।ওঁদের সাথে কোরবানির ঈদ করব,তাই গ্রামে যাচ্ছি।’

ছেলের এমন জবাব শুনে ঝুমুরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ঝুমুর বলেন,ছেলে দাদা-দাদিকে ভালোবাসে।আবার চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গেও খেলতে ভালোবাসে।তাই ও গ্রামে যেতে চায়।’

পরিবার-পরিজন,আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেষ দিনের মতো আজ বুধবার রাজধানী শহর ছেড়ে যাচ্ছেন মানুষ।সকাল থেকেই বৃষ্টি থাকলেও তা উপেক্ষা করেই বহু মানুষ ছুটছেন। অনেকের পক্ষেই ঈদ ছাড়া প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয় না।

বেসরকারি চাকরিজীবী মো. শরাফ উদ্দিনের স্ত্রী,৪ বছর বয়সী এক ছেলে ও ৯ বছর বয়সী এক মেয়েকে নিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন তিনি।তাঁর মা–বাবা মারা গেছেন।মেজ এক ভাইও মারা গেছেন।গ্রামে এক ভাই থাকেন। আরেক ভাই ঢাকায় থাকেন,তিনি বাড়িতে গেছেন।শরাফ উদ্দিন বলেন,বেসরকারি চাকরি করি।ছুটি কম পাই।দুই ঈদে বড় দুটি ছুটি পাই।তাই চেষ্টা করি এই দুই ঈদে গ্রামে যাওয়ার,সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার।’

আরও খবর

Sponsered content