অপরাধ-আইন-আদালত

শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে একটি ‘বড় অধ্যায়ের অবসান’

  প্রতিনিধি ২৪ জুন ২০২৩ , ৪:৪২:০২ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে একটি ‘বড় অধ্যায়ের অবসান’ বলে মনে করছেন ডিএমপির সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।

শুক্রবার গ্রেপ্তারের পর শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মত জানান।

এ নিয়ে শামিন তিনবার গ্রেপ্তার হলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “শুক্রবার গ্রেপ্তারের সময় তার কাছে একটি বিদেশি পিস্তল আইডির ডেটোনেটর, জেল এক্সপ্লোসিভসহ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।”

শামিনের কাছ থেকে উদ্ধার করা মোবাইল এবং ল্যাপটপে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান,২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বন্দি থাকা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি,হুজি,আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে শামিনের সখ্য গড়ে ওঠে।২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পেয়েই শামিন নতুন সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন।২০২২ সালের শুরুতে পাহাড়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বসে তিনি সংগঠনের নাম দেন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।

শামিনের সঙ্গে তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন,শামিনের এই স্ত্রী আগে আনসার আল ইসলামের প্রধান নেতা ইজাজ কারগিলের স্ত্রী ছিল।ইজাজ পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর সেখানে তিনি ড্রোন হামলায় নিহত হন।এরপরেই সংগঠনের সিদ্ধান্তে ইজাজের স্ত্রীকে বিয়ে করেন শামিন।”

জামাতুল আনসারের নেত্রী নাজনীন সংগঠনের কয়েকজন শুরা সদস্যের স্ত্রীকে নিয়ে নারী শাখার দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন বলে জানান সিটিটিসি প্রধান।

আসাদুজ্জামান বলেন,শামিনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে আরও তথ্য পেলে পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে।

শামিন মাহফুজ ১৯৯২ সালে রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি ও ১৯৯৪ সালে এইচএসসিতে পাস করেন।দুই পরীক্ষাতেই মানবিক বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় স্থান ছিল তার।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন তিনি।

ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় শামিন ইসলামী ছাত্র-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় সেখান থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয় বলে সিটিটিসি জানতে পেরেছে।

মাস্টার্সের পরে রাজধানীর একটি কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন শামিন।এরপর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে।শিক্ষকতার কারণেই শামিন জঙ্গি সংগঠনে ‘স্যার’ হিসেবে পরিচিতি পান বলে র‌্যাব জানিয়েছিল।

নাথান বমের সঙ্গে সখ্য:-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শামিনের বন্ধুত্ব হয় চারুকলার শিক্ষার্থী নাথান বমের সঙ্গে,যিনি এখন পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ বা ‘বম পার্টি’র প্রধান।

সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামানের ভাষ্য,জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর উদ্দেশ্যেই নাখান বমের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন শামিন।

এর আগে র‌্যাব জানিয়েছিল,উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় শামিন মাহফুজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে ভর্তি হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘পাহাড়ি জাতি-গোষ্ঠী’।

গবেষণার অংশে হিসেবে তখন থেকে শামিন পাহাড়ে যেতেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দোছড়ি ইউনিয়নে তিনি লেবু বাগান করার জন্য জমিও নিয়েছিলেন।

তবে গবেষণা ও খামারের আড়ালে ‘উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে’ যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০১১ সালে বান্দরবানের থানচি থানার একটি মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন।

শামিন মাহফুজ প্রথম গ্রেপ্তারের বিষয়ে অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন,“প্রথম গ্রেপ্তারের পর জামিনে বের হয়ে জঙ্গি তৎপরতা অব্যাহত রাখে শামিন।২০১৪ সালে যাত্রাবাড়ী থেকে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়।আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানোর পর কাশিমপুর কারাগারে পূর্বে গ্রেপ্তার হওয়া হুজি ও জেএমবির শীর্ষ নেতা সাইদুর রহমান, মুফতি হান্নান,আবু সাঈদের সান্নিধ্যে আসেন শামিন মাহফুজ।

“২০১৮ সালে জামিনে বের হওয়ার পর শামিন সস্ত্রীক আত্মগোপনে থেকে নতুন সংগঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করে।”

পাহাড়ে কেএনএফের ছত্রছায়ায় জঙ্গি সংগঠনটির প্রশিক্ষণের বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান জানান,২০২০ সালের শুরুর দিকে কক্সবাজারের একটি হোটেলে দুই সংগঠনের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়।এতে জামাতুল আনসারের তরফে সমন্বয়ক শামিন মাহফুজ ও আমির মাইনুল ইসলাম স্বাক্ষর করেন, আর বম পার্টির তরফে সই করেন নাথান বম।

“তাদের মধ্যে এতদিন যে সমঝোতার কথা শোনা যাচ্ছিল, সে সংক্রান্ত যে সমঝোতা স্মারক হয়েছিল- সেটা শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের পর তার ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।এখানে কুকি চিন কিভাবে সহযোগিতা করবে তার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।আর এরপরেই কুকি চিনের আশ্রয় প্রশ্রয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পাহাড়ে জামাতুল আনসারের ক্যাম্প করা হয় কেএনএফের ক্যাম্পের পাশে; বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাত্রি ক্রাংসা ইউনিয়ন থিনদলতে পাহাড়ে। এরপর তারা রাঙামাটির বিলাইছড়ি থানার বড়তলি ইউনিয়নের রেংরাং পাহাড়ে ক্যাম্প গাড়েন।

সবশেষ তারা বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার রনিংপাড়া ইউনিয়নের সিঞ্জি পাহাড়ে অবস্থান করে,যা সিথি ক্যাম্প নামে পরিচিত।সমঝোতা অনুযায়ী কেএনএফ অর্থের বিনিময়ে জামাতুল আনসারের সশস্ত্র জিহাদীদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে বলে জানান সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান।

গত বছরের শেষ দিকে পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে জঙ্গি সংগঠনটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,তখন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সকল সদস্যকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছিল কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান নাথান বম।কিন্তু এই প্রস্তাব নাকচ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য নির্দেশ দেন শামিন মাহফুজ।”

অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন,“আমরা এমন একটা গোপন আলাপচারিতা উদ্ধার করেছি,যেখানে বলা হয়েছে-‘ওরা আক্রমণ করলে ওদের এমন করে ধাওয়া করবেন,যেন একটাও পালিয়ে না বাঁচতে পারে। যুদ্ধ হবে আক্রমণাত্মক, রক্ষণাত্মক নয়’।”

নিখোঁজদের সূত্র ধরে নতুন দলের সন্ধান:-

কুমিল্লা ও ঢাকার সাত কলেজছাত্র গত ২৩ অগাস্ট বাসা থেকে বেরিয়ে আর না ফেরায় থানায় জিডি করেছিল পরিবার।পরে জানা যায়,নিরুদ্দেশ ওই তরুণদের কয়েকজনকে শেষবার দেখা গিয়েছিল চাঁদপুরে।

অক্টোবরের শুরুতে কয়েকজনকে উদ্ধার করে র‌্যাব জানায়, ওই তরুণরা নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যুক্ত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ঘর ছেড়েছিলেন।আলোচনায় আসা জঙ্গি সংগঠনটি নিয়ে এরপর নানা ধরনের তথ্য দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান জানান,গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে,জামাতুল আনসারের উদ্দেশ্য ছিল দেশ এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ পরিচালনা করা।

“তারা মনে করে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে যারা কাজ করে,আইন প্রয়োগের জন্য যারা কাজ করে-তারা মুরতাদ। আর এজন্য অনেক তরুণ যুবককে বিভ্রান্ত করে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিয়েছিল।”

আরও খবর

Sponsered content