অপরাধ-আইন-আদালত

যে আইন শিশু,নারী ও নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারছে না,সে আইন বাতিলের কোনো বিকল্প নেই

  প্রতিনিধি ১১ এপ্রিল ২০২৩ , ৫:২৭:৫৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই সাধারণত বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) মামলা করছেন।এই আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।এতে মানুষের মতপ্রকাশ স্বনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে।আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।এই শঙ্কা জানিয়ে আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী,অধ্যাপক ও মানবাধিকারকর্মীরা।

আজ মঙ্গলবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের উদ্যোগে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: অভিজ্ঞতা ও শঙ্কা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ দাবি জানান তাঁরা।

ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক কোনো আইন প্রণয়নের আগে তা নিয়ে সংসদে যথাযথ আলোচনা না হওয়ার কথা তুলে ধরেন।তিনি প্রশ্ন করেন,৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ীর এই সংসদে আইন নিয়ে কী আলোচনা হবে,শুধু ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে বলা ছাড়া?

শাহদীন মালিক বলেন,পশ্চিমা বিশ্বে মানহানি,ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো বিষয়কে ফৌজদারি অপরাধ থেকে ১৮০০ সালের পর বাদ দেওয়া হয়েছে।সেখানে একটি কথা বলার জন্য ডিএসএতে একাধিক মামলা হচ্ছে।

সভাপতির বক্তব্যে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন,ডিএসএ একটি নিবর্তনমূলক আইন।এ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে,ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা।প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা এ ভয় ও আতঙ্কের সংস্কৃতি এবং স্বনিয়ন্ত্রণকে আরও ব্যাপক করেছে।এসবের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন,ডিএসএতে প্রতিদিন গড়ে চারজনের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে।তিনি বলেন,জনগণের সুরক্ষার নামে আইনটি কতিপয় ব্যক্তি,গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা দিতে তৈরি করা হয়েছে।জনগণের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।দেশে ভয়–ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করা হয়েছে।শুধু এ আইন না,নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে,বিভিন্ন আইনের ব্যবহার আরও বাড়বে।

ডিএসএ বাতিলের দাবি জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন,গোটা শাসনব্যবস্থায় এখন রাষ্ট্র,ব্যক্তি,দল সব একাকার করা হয়েছে।এই পরিস্থিতিতে ডিএসএর মতো আইনের প্রয়োগ আরও বাড়বে।যে আইন শিশু,নারী ও নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারছে না,সে আইন বাতিলের কোনো বিকল্প নেই।

ডিএসএর আওতায় কেউ নিরাপদ নয় বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল-১৯–এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুখ ফয়সল। তিনি বলেন, দেশ, গণতন্ত্র ও দল এক না। এটা যদি ধারণা হয় যে একটা আইন দরকার সরকার ও সমর্থকদের রক্ষা করার জন্য, তাহলে মুশকিল। দেশের মালিক জনগণ। এ ধরনের আইন দিয়ে সরকার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, এ ধরনের অত্যাচার তত বাড়বে। তিনি বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা থাকে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা বলতে সরকারের নিরাপত্তা না, এটা জনগণের নিরাপত্তা—এমন কোনো আইন থাকা উচিত।

ফারুখ ফয়সল বলেন, আগামী নির্বাচনের আগে আরও তিনটি আইন–বিধির খসড়া তৈরি হয়েছে—উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ওটিটি নীতিমালা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রবিধান। এগুলোতে জনগণের বারোটা বেজে যাবে। কে কী করে না করে, সবকিছু সরকারের হিসাবে থাকবে। ভয়ের সংস্কৃতির কারণে স্বনিয়ন্ত্রণ শুধু সাংবাদিকদের মধ্যেই সীমাবব্ধ নেই, সবার মধ্যেই আছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, ডিএসএর অধীনে অনুভূতিতে আঘাত লাগার কারণে যখন–তখন যে কেউ মামলা করে দিচ্ছে। মামলাগুলো করছে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ও ক্ষমতাসীনেরা। আইনটি সংশোধনের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এটা বাতিলই করতে হবে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (ইউএসএ) কান্ট্রি স্পেশালিস্ট সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন,ডিএসএতে মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হচ্ছে।মামলার শিকার হয়ে কেউ যদি দীর্ঘদিন জেল খেটে পরে নির্দোষ প্রমাণিত হন,তখন তার প্রতিকার কী হবে?

আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন,আইনটি সংশোধনের দাবি করা হলে ঘুরেফিরে একটি–দুটি ধারা বাতিল করে আরও তিনটি ধারা রাখা হবে।সে কারণে এটি বাতিলই প্রয়োজন।

অধ্যাপক স্বপন আদনান বলেন,ডিএসএর মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে,নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, শাস্তিযোগ্য অপরাধ বানানো হচ্ছে।গণতান্ত্রিক সমাজে সংসদের একটি ভূমিকা আছে,এসব বিষয়ে আলোচনা–সমালোচনা করার। কিন্তু এ বিষয়ে তা হয় বলে জানা নেই।মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার পরিপন্থী আইন এটি।

গবেষক মুশফিক ওয়াদদু বলেন,যে বিষয়গুলো সংকটে ফেলতে পারে,সেখানে সাংবাদিকেরা স্বনিয়ন্ত্রণে যাচ্ছেন, সেগুলো নিয়ে লিখছেন না।এর প্রভাব সাংবাদিকতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হবে।

সাংবাদিক মনির হায়দার ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন।

আরও খবর

Sponsered content