জাতীয়

যে অভিযোগ করেছিলেন এনজিও কর্মকর্তা প্রিয়া সাহা,তার ব্যাখ্যা দিলেন সাড়ে চার বছর পর!

  প্রতিনিধি ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৬:৫৪:৫৮ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ‘নির্যাতনের’ যে অভিযোগ করেছিলেন এনজিও কর্মকর্তা প্রিয়া সাহা,তার ব্যাখ্যা দিলেন সাড়ে চার বছর পর।

যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু,বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার তথ্য দিয়ে আলোচনায় আসা প্রিয়া সাহা বলেছেন, ‘নিজ চোখে দেখা’ সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র আর গুম-খুনের পরিসংখ্যান জেনেই তিনি ওই কথা বলেছিলেন ট্রাম্পকে।

নিউ ইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে শনিবার ‘হিন্দু মিলনমেলা নিউ ইয়র্ক’ নামের একটি সংগঠন আয়োজিত হিন্দু সমাবেশে কথা বলছিলেন প্রিয়া সাহা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন,একটা কথা বলা খুব দরকার।আপনারা হয়ত অনেকে জানেন না যে,আমি কেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে এই কথাগুলো তুলে ধরেছিলাম। এসব সংগঠন (বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ) থেকে যেমন জেনেছি,নিয়মিত বুঝেছি,আর কেউ যদি মনে করে যে হঠাৎ করে (ট্রাম্পের সাথে) দেখা হয়েছে আর বলেছি, এটা কিন্তু তা নয়।

“ওই পরিসংখ্যানগুলো,বিষয়গুলো তো আমার মধ্যে থাকতে হয়েছে,জানতে হয়েছে।আমাকে গুছিয়ে বলতে হয়েছে আমার সামর্থ্য অনুসারে এবং ঠিক ৪৩ সেকেন্ডের মধ্যে আমি অনেকগুলো বিষয় বলে ফেলেছি,যা দিয়ে মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে, তোলপাড় করেছে, প্রতিবাদ করেছে।”

পিরোজপুরের মেয়ে প্রিয়া সাহার স্বামী মলয় কুমার সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা।তাদের দুই মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন।শারি’ নামে বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায় নিয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক ছিলেন প্রিয়া।ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দলিত কণ্ঠ’ নামের একটি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক তিনি।সেইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক।

২০১৯ সালের ১৭ জুলাই ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর উদ্যোগে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন প্রিয়া সাহা। হোয়াইট হাউজে ডনাল্ড ট্রাম্পকে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন।

ওই কথার ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। তার দেওয়া পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, দেশে প্রতিবাদও হয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে তখন বলা হয়, “দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যেই প্রিয়া সাহা এই ধরনের বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ করেছেন।”

আর বাংলাদেশ হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সে সময় বলেন, “প্রিয়া সাহা হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের কাছে যে অভিযোগ করেছেন, তা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য, সংগঠনের নয়।”

ওই ঘটনার দীর্ঘদিন পর শনিবার প্রিয়া সাহা বলেন,তিনি ছোটবেলায় দেখেছেন তার পূর্বপুরুষদের অনেক জমি ছিল। এখন পর্যন্ত তিনশ একর সম্পত্তি রয়েছে তার বাপ-দাদাদের, সেই জমি এখন ‘দখল করে খাচ্ছে’ স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা।আর সেজন্য তিনি রাজনীতির ‘সবচাইতে প্রভাবশালী’ ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করছেন।

“একটি গ্রামকে কীভাবে সিস্টেমেটিকভাবে উচ্ছেদ করে তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল আমাদের গ্রাম।ধরেন যখন ফসল হয়,আমরা রাতে ঘুমাতে পারতাম না।সবাই বলে যে আজানের ধ্বনি শুনলে তাদের মন ভালো হয়ে যায়,আর আমি আঁতকে উঠি।কারণ ভোর রাতে তারা গরু ছেড়ে দিত, আজানের পর তারা হয় ফসল কেটে নিয়ে যাবে, নয়ত আক্রমণ করবে।

“দ্বিতীয় পর্যায়ে হল- তারা আমাদের ঘের থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের বিধবা জেঠিমার গাভিটি জবাই করে খেয়ে পেটের বাছুরটা ভাসিয়ে দেয় নদীতে।তার কোনো বিচার হয়নি।আমাদের অঞ্চলে (পিরোজপুর) বানিয়ারি নামে একটি গ্রাম আছে।সেই গ্রামে দুই-তিন বছর পরপরই একজন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।সেই পাড়ায় বৈষ্ণব বাড়ির একটি ছেলেকে মেরে ফেলল।হত্যার পর সুপারি গাছে চারদিকে চার হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় লাশটি। ছেলেটির চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল।বৈষ্ণব পাড়ায় দেড় শতাধিক হিন্দু পরিবার ছিল,ওই ছেলেটিকে হত্যার পর ৬ মাসের মধ্যে পুরো বৈষ্ণব পাড়ার সকলে ভারতে চলে গেল। এর তিন বছর পর আরেকজনকে হত্যা করা হয় পাশের পাড়ায়। তারও চোখ উঠিয়ে পুকুরে লাশ চুবায়ে রাখল।”

প্রিয়া সাহা বলেন, “৩ বছর পার হতে না হতেই উত্তর বানিয়ারিতে ঘরে ঢুকে আমার এক কাকাতো ভাইকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করে।এই যে মানুষ হত্যা করে ক্রমান্বয়ে একটি আতঙ্ক তৈরি করে,তার কোনো বিচার হয় না।আমার এক কাজিন ব্রাদার বীরেন বিশ্বাসকে দিনের বেলায় পিটিয়ে হত্যা করল। আপনারা বলবেন মামলা হয়েছে কিনা।প্রতিটির হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেই মামলা হয়েছে।আমাদের অঞ্চলের মানুষেরা মামলা করতে খুব জানে।কিন্তু ওই যে যেই জজ, সেই পুলিশ,সেই উকিল, সরকারি উকিল,ফাইনালি কিছু হয় না।”

‘মিথ্যা মামলা দিয়ে’ সংখ্যালঘুদের বছরের পর বছর হয়রানির অভিযোগ তুলে তিনি বলেন,বছরের বড় একটি সময় কোর্টে অতিবাহিত করার পরিবর্তে অনেকে ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন।সর্বশেষ আমাদের জায়গার ওপর একশ চিংড়ির ঘের আছে।সেগুলো তারা দখল করে নিল। ২০০৪ সালে আমার বাবার জমির ওপর বিশাল ইটের ভাটা করল।কত মামলা-মোকদ্দমা করা হল,কেউ শোনে না।”

ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সাড়ে ৪ বছর আগে নালিশের পর আর দেশে ফেরেননি প্রিয়া সাহা। ওয়াশিংটনে এখন একটি এনজিওর আশ্রয়ে রয়েছেন।বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পরিস্থিতি নিয়ে কংগ্রেস ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে আলোচনার কথা জানান তিনি।

আয়োজক সংগঠনের প্রধান রামদাস ঘরামি,প্রভাত চন্দ্রদা, অশোক কর্মকার,দ্বীজেন ভট্টাচার্য,দীলিপ নাথ, সোকরানী ধনপাত,শিতাংশু গুহ, সবিতা দাস ও সুশীল সিনহা হিন্দু সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।

আরও খবর

Sponsered content