সারাদেশ

ত্রুটি চিহ্নিত করে বাতিল-দালাল ধরলেই “চ্যানেল ফাইল’” হিসেবে সহজে মিলছে পাসপোর্ট

  প্রতিনিধি ৭ জুন ২০২৪ , ৫:২০:২৮ প্রিন্ট সংস্করণ

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি।।ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে নিয়ম মেনে পাসপোর্টের আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিলে ত্রুটি দেখিয়ে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে।সেখানে দালাল থাকলেও বদলে গেছে দালালির ধরন।কম্পিউটারের দোকানে অতিরিক্ত টাকা বা ঘুষ দিয়ে আবেদন ফরম জমা দিলে ‘চ্যানেল ফাইল’ হিসেবে সহজে মিলছে পাসপোর্ট। অনিয়ম–দুর্নীতি যেন এখানে নিয়ম ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

হাশেম আলীর বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বালিয়া গ্রামে।নিজের পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দিতে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে। তাঁর কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়,ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের আওতায় একটি ‘জাতীয়তা ও চারিত্রিক প্রশংসাপত্র’।সেখানে শুধু হাশেম আলীর নাম,তাঁর বাবার নাম ও মায়ের নাম লেখা।হাশেম আলী কোন ওয়ার্ডের বা কোন মহল্লার বাসিন্দা সেসব ঘর ফাঁকা।জাতীয়তা ও চারিত্রিক প্রশংসাপত্র নামের ফরমের নিচে কোনো কর্মকর্তার পরিচয় ছাড়া শুধু একটি আনকোরা হাতের স্বাক্ষর করা।

জাতীয়তা ও চারিত্রিক প্রশংসাপত্র নামের উদ্ভূত রকমের ফরমটির ক্রমিক নম্বরের পাশে ফাঁকা স্থানে হাতে লেখা একটি বিশেষ ‘কোড’।সেই কোডে বড় হাতের তিনটি ইংরেজি বর্ণ লেখা।এরপর ইংরেজিতে লেখা সংখ্যা (53)। কোডটি পাসপোর্টের দালালের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।এ কোড দেখে পাসপোর্ট অফিসের ফরম জমা নেওয়া কর্মচারী কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই আবেদনটি জমা নিয়ে নিলেন।৪ মে বেলা পৌনে একটার দিকে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে এমন ঘটনা ঘটে।

এর কিছুক্ষণ আগে আবেদন জমা দিতে না পেরে হতাশ হয়ে বের হন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চুরখাই এলাকার তরুণ সাব্বির আহমেদ।তাঁর আবেদনটি ‘ত্রুটি’ থাকায় জমা নেওয়া হয়নি।এরপর সাব্বির আহমেদ তাঁর দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কার্যালয়ের বাইরে একটি দোকানে যান দালাল ধরতে।

সাব্বির আহমেদ বলেন,আমার সব কাগজ ঠিকই ছিল। তবে জমা না নিয়ে পরের দিন যেতে বলল।’

গত ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা থেকে পাসপোর্টের আবেদন করতে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে যান আজহারুল ইসলাম।দীর্ঘ লাইনে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি জমা দেওয়ার সুযোগ পান।তবে কাগজপত্রে ভুল ধরে আবেদন জমা নেওয়া হয়নি।এভাবে দুই দিন চেষ্টা করেও আজহারুল ইসলাম পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে পারেননি।প্রতিবারই নতুন নতুন ভুল ধরা হয়। আজহারুল ইসলাম দালাল ধরতে নারাজ ছিলেন।পরে ২৮ এপ্রিল তিনি ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক বছির আহম্মেদের কাছে যান।সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও কেন আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে না,জানতে চাইলে বছির আহম্মেদ দ্রুত আবেদনটি গ্রহণ করেন।পরে ১৬ মে আজহারুল ইসলাম নিজের পাসপোর্ট পেয়ে যান।

এমন হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়টি আজহারুল ইসলাম কাছে অভিযোগ করেন।তাঁর এমন অভিযোগের পর অন্তত পাঁচ দিন ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসে এবং অফিসের বাইরে থাকা বিভিন্ন দোকানে কথা বলে ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি জানা যায়।

এখন প্রতিটি দোকান থেকে চ্যানেল ফাইল করে দেওয়া হয়। বিনিময়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে বেশি নেওয়া হয়।এ টাকার মধ্যে ১ হাজার ২০০ টাকা দেওয়া হয় পাসপোর্ট কার্যালয়ে। বাকি টাকা দালালদের পকেটে।

ময়মনসিংহ নগরের মাসকান্দা এলাকায় অবস্থিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে আছে অন্তত ৩০টি দোকান। এসব দোকানে প্রকাশ্যে কম্পিউটার কম্পোজ,ফটোকপি ও অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন করা হয়।আর গোপনে প্রায় সব দোকান থেকেই পাসপোর্ট অফিসের দালাল হিসেবে কাজ করা হয়।পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে গ্রামের লোকজন আশামাত্রই পড়ে যান দালালদের খপ্পরে।

দালালদের মাধ্যমে জমা দেওয়া পাসপোর্টের আবেদন ফরমকে বলা হয় ‘চ্যানেল ফাইল’।চ্যানেল ফাইলের বিষয়ে কথা হয় তিনজন দালালের সঙ্গে। শুরুতে তাঁরা এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি।

পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন,পাসপোর্ট অফিসের এ ধরনের দালালির বিষয়টি মোটামুটি ‘ওপেন সিক্রেট’।আগে দালালেরা পাসপোর্ট অফিসের সামনে ঘুরে ঘুরে গ্রাহক ধরতেন।তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযানের কারণে এখন দালালির ধরন বদলে গেছে।এখন প্রতিটি দোকান থেকে চ্যানেল ফাইল করে দেওয়া হয়। বিনিময়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে বেশি নেওয়া হয়।এ টাকার মধ্যে ১ হাজার ২০০ টাকা দেওয়া হয় পাসপোর্ট কার্যালয়ে। বাকি টাকা দালালদের পকেটে।এভাবে ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।

চ্যালেন ফাইলটি করা হয় অত্যন্ত কৌশলে।আবেদনের কাগজপত্রের সঙ্গে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের নামে করা ভুয়া জাতীয়তা ও চারিত্রিক প্রশংসাপত্র জুড়ে দেওয়া হয়। সেখানে দেওয়া হয় সেই বিশেষ কোড।কোড দেখেই আবেদন গ্রহণকারী কর্মচারী বুঝতে পারেন,এটি কার দালালিতে এসেছে।পরে যাচাই-বাছাই ছাড়াই জমা নেওয়া হয়।ওই তিন দালাল আরও বলেন,এভাবে কোড নম্বর দেওয়া আবেদন ফরমগুলোর প্রতিদিন হিসাব রাখা হয় পাসপোর্ট কার্যালয়ের পক্ষ থেকে।পরে সপ্তাহের প্রতি বুধবার হিসাব অনুযায়ী, টাকা গ্রহণ করে থাকেন পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মচারী।

পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া কাজ হয় না,এটি সবাই জানেন।বিষয়টি এখন জেনেও মেনে নেওয়ার মতো হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট কার্যালয়ের উপ-$সহকারী পরিচালক বছির আহমেদ বলেন,বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।

চার দিন ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাওয়া যায়নি উপপরিচালকে মোরাদ চৌধুরীকে।তবে গত মঙ্গলবার দুপুরে কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় মোরাদ চৌধুরীর সঙ্গে।

তিনি বলেন,কার্যালয়ের বাইরে কিছু দালাল শ্রেণির লোক থাকেন।এসব লোকের ব্যাপারে পাসপোর্ট করতে আসা মানুষদের সতর্ক থাকতে বলা হয়।তবে সিটি করপোরেশনের নামে ভুয়া জাতীয়তা ও চারিত্রিক প্রশংসাপত্র সনদে কোড নম্বর দেওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না।পাসপোর্ট অফিসের কোনো কর্মী এ জন্য টাকা নেন কি না,এসবও তিনি জানেন না। তবে এ বিষয়ে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন,‘পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া কাজ হয় না,এটি সবাই জানেন।বিষয়টি এখন জেনেও মেনে নেওয়ার মতো হয়ে গেছে।সম্প্রতি আমার ভাগনে এক মাস ঘুরেও আবেদন জমা দিতে পারেনি।পরে দালাল ধরে আবেদন করে পাসপোর্ট পেয়েছে।এ বিষয়ে প্রশাসনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

আরও খবর

Sponsered content