আন্তর্জাতিক

ভানুয়াতুতে নিয়ে আসা বাংলাদেশিরা সোমনের দাসে পরিণত হয়েছিলেন

  প্রতিনিধি ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ১২:৫৩:৪৯ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর শাহিন।যখন তিনি দেশের বাইরে চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন, তখন কল্পনাও করতে পারেননি প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপে তাকে দাসত্বের জীবন কাটাতে হবে।কাজ করতে হবে বিনা বেতনে।এ নিয়ে অভিযোগ করলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে।একপর্যায়ে পালিয়ে অন্যত্র গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছেন এই বাংলাদেশি।

শাহিন যখন বিদেশে কাজের সুযোগ পান,তখন বলা হয়েছিল–একজন কোটিপতি উদ্যোক্তার বুটিকে কাজ করতে হবে তাকে।তবে,তার সেই আশা মাটি হয়ে যায় নিমিষেই। আধুনিক সভ্যতার এ যুগেও তাকে দাসত্বের জীবন কাটাতে হবে,এমনটি কোনোদিন ভাবেননিএমনকি,৫০ বছর বয়সী শাহিন মারধরের শিকার ও হত্যার হুমকিও পেয়েছেন।

সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও ভয় করে শাহিনের। তিনি বলেন,আমি একটি জীবন্ত মরদেহ ছিলাম।বাংলাদেশের রাস্তা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ ভানুয়াতুতে আমাকে নিয়ে আসা হয়।সামান্য খাবার ও ক্রমাগত ভয়ের মধ্যেই অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো।’ পালানোর পর পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও তারা শব্দ বের হচ্ছিল না।তিনি বলেন,আমি কথা বলতে পারছিলাম না।আমার হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে।আমার সব স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ধুলোয় মিশে গেছে।’

শাহিন সেই শতাধিক বাংলাদেশির মধ্যে একজন,যাদেরকে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে প্রশান্ত মহাসগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিতে আনা হয়।তাদেরকে এ দেশে এনেছিলেন সেকদাহ সোমন নামের একজন মানব পাচারকারী,যিনি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা দাবি করেছিলেন।

প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে কীভাবে মানব পাচার হয় এবং আধুনিক সভ্যতায় দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা স্পষ্ট হয় এই ১০৭ বাংলাদেশির মাধ্যমে।

দীর্ঘ পাঁচ বছর আলোর মুখ দেখতে পারেননি শাহীন ও তার সঙ্গীরা।এ সময় তাদের অপব্যবহার ও শারীরিক নির্যাতন করা হতো। কর্তৃপক্ষের শঙ্কা,ভানুয়াতুর মতো ছোট দেশগুলো ভালো জীবন সন্ধানকারী দুর্বল লোকদের গন্তব্য হতে চলেছে।ধোঁকা দিয়ে ওসব দেশে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের এনে দাসত্বে বাধ্য করা হচ্ছে।

অভিবাসীদের কার্যক্রম নিয়ে বেশ কঠোর ভানুয়াতু সরকার। নিয়ম পালনে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে দ্বীপ দেশটি। এরপরেও সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ১০৭ বাংলাদেশিকে অপব্যবহারের ঘটনা জানাজানি হয়নি। এর মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে মানব পাচারের বিরুদ্ধে অভিযানের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়।

২০১৮ সালের জুনে সেকদাহ সোমনের সহযোগীদের সঙ্গে টাঈাইলের একটি বাস স্টেশনে দেখা করেন শাহিন।এরপর থেকেই তার অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয়।শাহিনকে বলা হয়,সোমন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং সারা বিশ্বে তার ফ্যাশন ব্যবসা রয়েছে।

শাহিনকে বলা হয়,দক্ষিণ আফ্রিকার ব্র্যান্ড মি. প্রাইজের একটি আউটলেট খুলবেন সোমন।অনলাইনে এ কোম্পানির বিষয়ে অনেক কিছুই পাওয়া যায়।ভানুয়াতুর স্থানীয় গণমাধ্যমের একটি নিবন্ধন দেখেন শাহিন।যেখানে বলা হয়, মি. প্রাইজ দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ব্যবসা খুলতে যাচ্ছে।এ নিয়ে দেশটির জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর সঙ্গে কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক হবে। আর এটিই শাহিনের মাথায় আটকে যায়।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের ব্যবসা ছিল শাহিনের।সেই ব্যবসার বিপরীতে ঋণ নেন তিনি।এছাড়া আরও বিভিন্ন উপায়ে অর্থ জোগাড় করে সোমন ও তার সহযোগীদের দেন শাহিন।মূল উদ্দেশ্য ছিল,ভালো ভবিষ্যতের আশায় দেশের বাইরে যাওয়া। ব্যাগ গুছিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভানুয়াতু চলে যান তিনি।দীর্ঘ পাঁচ বছর ভানুয়াতুতেই রয়েছেন শাহিন। এখনও বাংলাদেশে ফিরতে পারেননি তিনি।

ভানুয়াতুর রাজধানী পোর্ট ভিলাতে যাওয়ার পরই শাহিনের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়।এরপর তাকে সমুদ্রের পাশের একটি বাংলোতে বন্দি করে রাখা হয়।বেশিরভাগ সময় ভাত ও বাঁধাকপি খেতে দেওয়া হতো তাকে।তার চলাফেরাও সীমাবদ্ধতা ছিল। শুধু কোনো অনুষ্ঠানে তাকে মাংস খেতে দেওয়া হতো।

২০২২ সালে সোমন,তার স্ত্রী ও দুই সহযোগীকে মানব পাচার,দাসত্ব,মানি লন্ডারিং,হত্যার হুমকি,নির্যাতন এবং দেশের কর্মসংস্থান আইন লঙ্ঘনে অভিযুক্ত করেন ভানুয়াতুর আইনজীবীরা।ওই বছরই আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন দেশটির প্রধান বিচারপতি ভিনসেন্ট লুনাবেক।রায়ে বিচারক লেখেন, ‘সেকদাহ সোমন ক্রমাগত বলছিলেন,তিনি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কী করতেন।তাদের গাড়িতে করে দৌড়ানো,কেটে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া,জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া ও ফ্রিজে রাখার হুমকি দিতেন। কখনো কখনো ভুক্তভোগীদের মরদেহের ছবি তুলে তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হবে বলেও হুমকি দিতেন সোমন।’

শাহিন আল-জাজিরাকে বলেন,সোমনের ক্রমাগত হুমকিতে তিনি কখনোই ভয় পাননি।ভানুয়াতু পৌঁছানোর দিনই সোমনের হয়ে কাজ করা এক বাংলাদেশি তাকে ঘুষি মেরেছিল বলেও জানান শাহিন।পরে নির্যাতন করে এবং অপহরণের কথা বলে তার পরিবারের কাছ থেকে ১৪ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড় লাখ টাকা) নেওয়া হয়েছিল।

রাগান্বিত,ভীত ও হতাশগ্রস্ত শাহিন এবং তার সঙ্গে থাকা আরও দুজন একদিন ভোর হওয়ার আগে ওই বাংলো থেকে পালিয়ে যান।তারা সৈকতের দিকে দৌড়ান এবং একপর্যায়ে উপকূল দিয়ে কাছের একটি সড়কে পৌঁছেন।পরে সেই সড়কে একটি গাড়িকে থামান শাহিন এবং চালককে বলেন, ‘পুলিশ স্টেশন।’

ব্র্যান্ডের নামে মানব পাচার ও দাসত্ব

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে শাহিনসহ আরও কয়েক ডজন বাংলাদেশিকে ভানুয়াতুতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন সোমন। এ সময় দেশটির কর্তৃপক্ষ কোনো সন্দেহ করেনি। অনেক বাংলাদেশিকে বলা হয়েছিল,সোমনের বুটিকে কাজ করার জন্য তাদের অস্ট্রেলিয়া,কিউবা বা নিউ ক্যালেডোনিয়ার ফ্রেঞ্চ প্যাসিফিক অঞ্চলে বৈধভাবে নেওয়া হচ্ছে।ভানুয়াতুর ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ক্ষেত্রে পাচারকারীদের সাহায্য করে ব্যবসায়িক জাল নথি, লাইসেন্স ও ঘুষ।

ভানুয়াতুতে নিয়ে আসা বাংলাদেশিরা সোমনের দাসে পরিণত হয়েছিলেন।তাদের তেমন কোনো কাজই ছিল না।তাদের শুধু হুমকিই দেওয়া হতো।দেশটির স্থানীয় এক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে,এসব লোকদের ভানুয়াতুতে আনার পর তাদেরকে নির্মাণকাজে বাধ্য করা হয়।কাঠের আসবাবপত্র তৈরি ও বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়।তারা অস্বীকার বা অভিযোগ করলে তাদের মারধর করা হয়।তাদেরকে প্রতিশ্রুত চাকরি ও মজুরি কখনোই দেওয়া হতো না।

তদন্ত কর্মকর্তাদের বিশ্বাস,সোমনের ভানুয়াতুতে ব্যবসায়িক কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।তিনি কেবল ভুক্তভোগীদের আটকে রেখে অর্থ নিতে চেয়েছিলেন।

শহরের কেন্দ্রে প্রাইজ ব্র্যান্ডের একটি শোরুম তৈরি করা হয়েছিল।তদন্তকারীরা পরে জানতে পারেন,সোমন কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিটি থেকে কেবল ফ্রঞ্চাইজি নিয়েছিলেন।প্রতিদিন শত শত লোক দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও দাসত্বের বিষয়ে আঁচ পাওয়া যেত না।অবশেষে যখন সোমনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল,তখন তিনি নিজেকে বাংলাদেশি নয়,জিম্বাবুয়ের নাগরিক দাবি করেন।যদিও তদন্তকারীরা পরে বুঝতে পারেন তার পাসপোর্টটি জাল।

অভিবাসী শ্রমিকদের বৃহত্তম উৎস বাংলাদেশ।তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি।তবে,বেশিরভাগ বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে বিদেশে যায়।এতে তাদের বিরাট পরিমাণের অর্থ গুনতে হয়।আর এতেই হাজার হাজার বাংলাদেশি মানব পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বাংলাদেশিদের পাচার নিয়ে ২০২২ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়,পাচারের সংখ্যা নিখুঁতভাবে যাচাই সম্ভব নয়।তবে,পাচারের দিক থেকে বিশ্বের সবার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের বাংলাদেশ মিশনের প্রধান আবদুসাত্তার এসোয়েভ বলেন,পাচারের শিকার হওয়াদের মিথ্যা বলা হয়।বিদেশে অভিবাসনের মাধ্যমে তার এবং তাদের সন্তানদের জীবন নিরাপদ করতে পারবেন বলে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়।অনেক মানুষ তাদের সম্পদ ও সারা জীবনের সঞ্চয় ব্যয় করে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে।এর মধ্যে অনেকে পাচারের শিকার হন।’

ভানুয়াতুর ক্রাইম ইউনিটের প্রধান চার্লি উইলি রেক্সোনা বলেন,ফিলিপাইন ও অন্যান্য এশীয় দেশ থেকে আসা কর্মীরা প্রায়ই বলেন,তাদের পাসপোর্টগুলো মালিকরা নিয়ে গেছেন, যা মানব পাচারের একটি স্পষ্ট লক্ষণ।

আরও খবর

Sponsered content