প্রতিনিধি ১০ এপ্রিল ২০২৩ , ১:৩৫:৩৭ প্রিন্ট সংস্করণ
অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।প্রায় ২০ বছর ধরে আলাপ-আলোচনার পর গভীর সমুদ্র এলাকা ব্যবহার ও সুরক্ষার বিষয়ে নতুন একটি চুক্তির বিষয়ে একমত হয়েছে জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলো।এই চুক্তিটি হলে বিশ্বের দেশগুলোর নিজেদের সীমানার বাইরে থাকা গভীর সমুদ্রের সুরক্ষা ও ব্যবহারের বিষয়টি একটি নীতিমালার ভেতরে চলে আসবে।
গভীর সমুদ্রের পরিবেশগত ভারসাম্য,জীববৈচিত্র রক্ষা ও মহাসমুদ্রের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই প্রস্তাবিত এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য।
এত দিন দেশগুলোর নিজস্ব সমুদ্রের একটি অংশ সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হতো।কিন্তু নতুন চুক্তিটি হলে বিশ্বের মহাসমুদ্রগুলোর অন্তত ৩০ ভাগ এলাকা ২০৩০ সালের মধ্যে সংরক্ষিত করে তুলতে হবে।এছাড়াও সমুদ্রের যেসব জেনেটিক সম্পদ ব্যবহার করে ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরি করা হয়,ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে তার মুনাফা বণ্টনের কথাও চুক্তিতে বলা হয়েছে।
এমন একটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল প্রায় ২০ বছর আগে। ২০১৮ সাল থেকে জাতিসঙ্ঘে দফায় দফায় আলোচনা ও বৈঠকের পর গত ৪ মার্চ নতুন এই চুক্তির আইনি কাঠামো তৈরির বিষয়ে সম্মত হয়েছে জাতিসঙ্ঘের দেশগুলো।
এখন সদস্য দেশগুলো তাদের নিজেদের দেশে অভ্যন্তরীণ আইনের প্রক্রিয়া শেষ করে সম্মতি জানালে এটি একটি পুরোপুরি চুক্তি হিসেবে অনুমোদন পাবে।তবে আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে অন্তত ৬০টি দেশকে এতে স্বাক্ষর করতে হবে।
কী লাভ হবে বাংলাদেশের?
প্রায় ১০ বছর আগে ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায় ছিল বাংলাদেশের পক্ষে।এর ফলে নিজস্ব সমুদ্রসীমার বাইরেও বিশাল এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এর আগে মিয়ানমারের সাথেও সমুদ্র-বিরোধ মীমাংসার রায় ছিল বাংলাদেশের পক্ষে।
তবে মহীসোপান নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখনো কিছুটা বিরোধ রয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের সমুদ্র বিষয়ক কনভেনশন অনুযায়ী,কোনো দেশের সমুদ্র উপকূল থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশে সংশ্লিষ্ট সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ওই দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু ২০০ নটিক্যাল মাইলের পর থেকে জাহাজ চলাচল উন্মুক্ত থাকবে এবং সব দেশ মাছ ধরতে পারবে।
সেই গভীর সমুদ্র এলাকার সুরক্ষা ও সেখানকার জলজ সম্পদের ব্যবহার নিয়েই নতুন চুক্তি করার আলোচনা চলছে।
অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মো: খুরশেদ আলম বলছেন, ‘আমাদের মূল জায়গাটা হলো,গভীর সমুদ্রের জৈবিক উপাদান যেমন স্পঞ্জ,কিলস,প্রবাল,সামুদ্রিক শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি সম্পদ,যেগুলোর জেনেটিক,মেডিসিন বা অর্থনৈতিক মূল্য আছে,সেগুলোর অধিকার পাওয়া।’
সাগরের ওয়াটার স্পঞ্জ থেকে হ্যালাভেন নামে ক্যান্সারের একটি ওষুধ তৈরি করছে জাপান।বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি এভাবে সমুদ্রের সম্পদ থেকে ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরি করে থাকে।কিন্তু এসব থেকে আশপাশের দেশগুলো এখনো কোনো সুবিধা পায় না।এছাড়াও নতুন চুক্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি ভাগাভাগি করার বিষয় থাকবে।
তবে গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে,কিভাবে এই মুনাফা ভাগাভাগি হবে,কোন দেশ কী হারে কত পাবে,তা এখনো পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে যে ১৩ হাজার জেনেটিক সম্পদের পেটেন্ট করা হয়েছে, সেগুলোর বণ্টন কিভাবে হবে,তা এখনো পরিষ্কার নয়।
খুরশেদ আলম বলছেন,কোনো দেশের সমুদ্র এলাকা বা তার বাইরে থেকে আহরণ করা সম্পদ থেকে যে আয় আসবে, তার একটা অংশ জাতিসঙ্ঘের ফান্ডে জমা রাখতে হবে। সেখান থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রযুক্তি ও অর্থ পাবে।এই চুক্তিতে সেই ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।’
তিনি বলছেন,বাংলাদেশ উপকূলীয় একটি দেশ হলেও সাগরের পুরো সম্পদের খুব কমই দেশটি ব্যবহার করে থাকে। এমনকি বাংলাদেশের অধিকার হলেও এত দূরে মাছ ধরার পরিমাণও খুব কম।ফলে গভীর সমুদ্রের সম্পদ থেকে পাওয়া অর্থের এই ভাগাভাগির ফলে বাংলাদেশে মতো দেশ বেশি উপকৃত হবে বলে।
তবে এই চুক্তিতে খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান বা মাছ ধরার মতো বিষয়গুলো না থাকায় এতে চুক্তির একটি দুর্বল দিক বলে বর্ণনা করছেন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা।
আলম বলছেন,এমন সম্পদ আহরণের সময় যাতে সাগরের জীববৈচিত্রের কোনো ক্ষতি না হয়,পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়,সেই সুরক্ষার বিষয়েও বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।’
এছাড়া প্রতিটা দেশের যতটুকু সাগর আছে, তার অন্তত ৩০ ভাগ সংরক্ষিত রাখার একটি বিধানও রাখা হয়েছে নতুন খসড়া চুক্তিতে।
তিনি বলছেন,খসড়া চুক্তিতে একমত হতেই লম্বা সময় লেগেছে।যেহেতু এখন দেশগুলো মোটামুটি একমত হয়েছে, এটি রেক্টিফায়েড বা পুরোপুরি আইনে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।’
তিনি আশা করছেন,এই বছরের মধ্যেই এই নতুন আইন কার্যকর হয়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা যেভাবে দেখছেন:-
সমুদ্রের সুরক্ষায় একটি আইনি কাঠামো তৈরির ব্যাপারে বিশ্বের দেশগুলোর একমত হওয়াকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয়তে।
বিভিন্ন প্লাটফর্মে আলোচনার পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরে আন্তঃসরকার সম্মেলনে প্রথম একটি খসড়া দলিল উপস্থাপন করা হয়েছিল।এরপর গত প্রায় ছয় বছর ধরে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
সমুদ্র বিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলছেন,গভীর সমুদ্র নিয়ে জাতিসঙ্ঘের ইউএনক্লজে তেমন কিছু ছিল না।গত আড়াই বা তিন দশক ধরে এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে।এত বছর পরে হলেও এ নিয়ে একটি চুক্তি করতে দেশগুলো যে সম্মত হয়েছে,এজন্য তাকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।’
তিনি বলছেন,বর্তমানে কোনো কোনো দেশ নিজেদের সমুদ্রসীমার কিছু অংশ সংরক্ষিত ঘোষণা করলেও আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার কোনো এলাকা সংরক্ষিত নেই।নতুন চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ সমুদ্রকে সুরক্ষার মধ্যে আনা।
তিনি জানান,এছাড়া সমুদ্রের সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বহুদিন ধরে মতবিরোধ ছিল। সেখানেও পুরোপুরি পরিষ্কার কোনো সমঝোতা হয়নি।
অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলছেন,বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুশি এ জন্য যে সমুদ্রের ৩০ ভাগ অঞ্চলের জীববৈচিত্র সুরক্ষা পাবে।কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুশি হতে পারছি না,কারণ আমাদের জন্য সেখানে এখনো কিছু নেই।’