সারাদেশ

বরিশাল-ভোলা সীমানা নির্ধারণ দীর্ঘদিন আইনী জটিলতায় আটকা-গ্যাস ও সড়ক যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত লাখো মানুষ

  প্রতিনিধি ২৩ নভেম্বর ২০২২ , ৮:১৪:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার- ভোলা জেলার সদর থানার সীমানা নির্ধারণের আইনী জটিলতা নিরসনে হাইকোর্টে রিট মামলা ৫৩৮৩-৮৫/২০০৭-৫৪৮৩-৫৪৮৫/২০০৭ শুনানির অপেক্ষায় ঝুলে আছে।আদালতের মামলার বর্ননা ও স্হানীয়দের সুত্রে জানাগেছে, ভোলা জেলার সদর উপজেলার ও বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নের সাথে ভোলা-বরিশাল আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণের বার বার সরকার উদ্যোগ নিলেও কতিপয় ভূমিদস্যুরা সরকারের উদ্যোগের বিরোধিতা করে আদালতে রীট মামলা দায়ের করেন। ভূমিদস্যুদের উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য আদালতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে।

ভোলা-বরিশাল আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণের আইনী জটিলতা নিরসন করতে না পারায় বরিশাল-ভোলা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্হা ও গ্যাস সংযোগ থেকে বঞ্চিত লাখো মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। উক্ত রীট মামলা বিচারাধীন থাকায় ভোলা-বরিশাল আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণের আইনী জটিলতা নিরসন সহসাই হচ্ছে না।

সুত্রটি জানায়,হাইকোর্টে রিট মামলা ৫৩৮৩-৮৫/২০০৭ ও ৫৪৩৮৩-৮৫/২০০৭ বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তি বা চুরান্ত শুনানির পর রায়ের সহিমোহর আদেশের অপেক্ষায় ঝুলে আছে ভোলা-বরিশাল আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণ। ফলে এ সকল রুটের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্হা ও গ্যাস লাইন সংযোগের বিরোধপূর্ণ জমি অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

এতে উভয় এলাকার জনগণের মাঝে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, হতাশা বিরাজ করছে। জানা গেছে, বরিশাল-ভোলা জেলার কতিপয় ভূমিদস্যুদের অপরাধ সংঘটিত করে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি করে। এনিয়ে ভোলা-বরিশাল আন্তঃজেলা বিরোধপূর্ণ জমি দখলের চেষ্টায় ফৌজদারি অপরাধে উভয় জেলার আদালতে ২০০৩-২০১৩ পর্যন্ত ১২টি মামলা হলেও এলাকার সচেতন মহলের প্রচেষ্টায় আপোষ শর্তে একে একে নিষ্পত্তি হয়েছে। পরবর্তীতে ভোলা জেলার সদর থানার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চরচটকিমারা দাবি পূর্বক ভোলা ভূমিদস্যু ওহিদ-বজলু সরদার বাহিনীর সঙ্গে বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য কাজী মেজবাহউদ্দিন ফরহাদের চাচাতো ভাই মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের বিএনপির সভাপতি কাজী সাখাওয়াত হোসেন রুবেল বাহিনীরা মহিষমারী দাবি পূর্বক জবরদখল নিয়ে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়। উক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে উভয় জেলায় ডজনখানেক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ (শ্রীপুর) ইউনিয়নের ভোলা জেলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের সংলগ্ন এলাকায় আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণের বিরোধপূর্ণ জমির মৌজা বাহের চর,মহিষমারী,ইলিশা-কোড়ালিয়া, ঘাগড়াটুমচর এই মৌজার সমূহ সিএস জরিপে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মৌজার ৪টির সিএস,আরএস অনুযারী জমির পরিমাণ যথাক্রমে বাহের চর ৫শ ৮৫একর,মহিষমারী ২শ ১৭একর,ইলিশা-কোড়ালিয়া ৭শ ৯৬একর,ঘাগড়াটুমচর ৫৪শ ৮একর জমি।তবে আরএস কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে ওই মৌজার সমূহ নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।আরএস রিভার ব্লক নামে পরিচিত। একারণেই রিভার ব্লক প্রস্তুত করে জরিপ সম্পন্ন করা হয়েছে।রাহা তেঁতুলিয়া নদী নামে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীতে তেঁতুলিয়া নদীতে চর জেগে উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় ভোলা জেলার সদর থানার ভূমি অফিস কর্তৃক ১৯৬৭/৬৮ সালে ইলিশা-কোড়ালিয়া, ঘাগড়াটুমচর মৌজার ৩শ ২৫একর ১শ ৯৭.১৮একর জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়। ভোলার বন্দোবস্ত স্বীকৃতি দিয়ে উপকৃত মৌজার ২টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পিজে ১/৭৩ এইচ এ(পুলিশ)/৫০২ নং প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৮/১১/১৯৭৫ তারিখে প্রকাশিত পূর্নরায় মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তার পরিপ্রেক্ষিতে ভোলা জেলার সদর থানার (রাজস্ব কর্মকর্তা) উক্ত মৌজার বন্দোবস্তের সকল কাগজপত্র মেহেন্দিগঞ্জ প্রেরণ করেন। মেহেন্দিগঞ্জের ভূমি অফিস কর্তৃক ১৯৮৬/৮৭ এবং ১৯৮৮/৮৯ সালে ইলিশা-কোড়ালিয়া মৌজার ৮১একর ও ঘাগড়াটুমচর মৌজার ২শ ৫০একর জমি বন্দোবস্ত প্রদান করে।ইলিশা-কোড়ালিয়া নামে ৪শ ৬.৬৫একর এবং ঘাগড়াটুমচর নামে ৪শ ৪৭.৯৮একর বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে।

ভোলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চরচটকিমারা হিসেবে ১৯৮২/৮৩ এবং ১৯৮৭/৮৮ সালে ২হাজার ৩শ ৩৫ একর জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত প্রদান করে।মা বর্তমানে সীমানা বিরোধের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।আরএস অতিরিক্ত ২হাজার ৩শ ৩৫একর বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যে দিয়ারা(বিএস) জরিপের মাধ্যমে ইলিশা-কোড়ালিয়া মৌজা মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দিয়ারা(বিএস) জরিপ কর্তৃক ১৯৯০ সালে ইলিশা-কোড়ালিয়া মৌজার চুরান্ত রেকর্ড মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দিয়ারা(বিএস) জরিপে উক্ত মৌজার জমির পরিমাণ ৭শ ২০.৮১ একর। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৫ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে সিএস জরিপে ও সর্বশেষ দিয়ারা(বিএস) জরিপ অনুসারে আলিশা কোড়ালিয়া এবং ঘাগড়াটুমচর মৌজা ২টি মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রেখে সীমানা নির্ধারণের আদেশ দেন। বরিশাল ও ভোলার প্রশাসনের যৌথ সিদ্ধান্ত মতে সীমানা নির্ধারণের জন্য ২৪ মে ১৯৯০ তারিখে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটে বর্নিত আছে।

২১ মে ১৯৮৭ তারিখে মন্ত্রী পরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভূঃমঃশাঃ(সীমা)৬২/৮৫(অংশ-১)/২৪৬ ভোলা-মেহেন্দিগঞ্জ আন্তঃজেলা ১৯৪০-৪২এবং ১৯৪৫-৫৩ সালের বাকেরগঞ্জ জেলার সংশোধন জরিপে প্রণীত ভোলা থানা ম্যাপে প্রদর্শিত হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ, বরিশাল, বাকেরগঞ্জ থানার সংলগ্ন ভোলার সীমা রেখা স্হায়ী বলে বিবেচিত হবে। ভোলা-বরিশাল এবং পটুয়াখালী আন্তঃজেলা সীমানা ১৯৩৯-৪৫ এবং ১৯৪৫-৫৩ সালের প্রনীত আরএস অনুযায়ী সীমারেখা নির্ধারণ হবে।এই মর্মে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভূঃমঃশাঃ-২(সীমা)-৬২/৮৫(অংশ-১)২৪৬ তারিখ ২৩ এপ্রিল ১৯৯০ এবং ভূঃমঃ/শাঃ-২(সীমা)-৬২/৮৫(অংশ-১)৫৮, তারিখ:-২৭ জানুয়ারি ১৯৯০ প্রজ্ঞাপন ২টি জারি করা হয়েছে।

পরবর্তীতে জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) ভূমি অধিদপ্তরের পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত ২ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন ভিত্তিতে আংশিক ভূঃমঃ/শাঃ-২(সীমা-নিঃ)
২৯/৯৪-৫৩৪ নং স্মারকে ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ আংশিক সংশোধন অবগত করে সীমানা নির্ধারণের আদেশ দেন।

ভোলা-বরিশাল ইলিশা-কোড়ালিয়া,ঘাগড়াটুমচর মৌজা ২টি মেহেন্দিগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত করে ভোলা-বরিশাল সীমানা নির্ধারণ করা হবে। ভোলা-বরিশাল আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণ আরএস লাইন অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। ভোলা-পটুয়াখালী আন্তঃজেলা সীমানায় অবস্থিত বুয়া গোরাঙ্গ এর দোকানের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত চরমনহর,চর মোতাহার,চর টিউলিপ, এলাকা চরফ্যাশন অন্তর্ভুক্ত করে ভোলা-পটুখালী আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণ করা হবে।

ভোলা-পটুয়াখালী আন্তঃজেলা সীমানা আরএস লাইন অনুযায়ী নির্ধারণ হবে।স্মারক নং রাজস্ব/৭-১(অংশ-১)২০০২-২৭৬(৬) বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ আব্দুল কুদ্দুস এর সভাপতিত্বে ২২ অক্টোবর ২০০৩ তারিখে বরিশাল বিভাগীয় সরকারি সকল প্রশাসনিক কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলা, ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়।

উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোলা জেলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চরচটকিমারা বাসিন্দা আব্দুল খালেক হাওলাদার সহ ২৩ জন‌ ভোলার জজ আদালতে দেওয়ানি ও আপীল মামলা ৩৯/২০০৪ তারিখ ১৮ জুলাই ২০০৪ আব্দুল খালেক হাওলাদার গং বনাম বিবাদী ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক সহ ভোলা-বরিশাল জেলা ও বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ-প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ভূমি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিবাদী করে মামলা দায়ের করে। উক্ত মামলাটি ৫জুন ২০০৭ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ জুন ২০০৭ উপরোক্ত বর্নিত সিদ্ধান্ত বহাল রেখে রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আপীল মামলা দায়ের করে।আপিল খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ৫৩৮৩-৮৫/২০০৭ এবং ৫৪৮৩-৮৫/২০০৭ রীট মামলা দায়ের করেন। মহামান্য হাইকোর্টে ৫৪৮৪/২০০৭ রীট মামলাটি শুনানি শেষে আদালত খারিজ করে দেন।এখনো ৫টি রীট মামলা বিচারাধীন থাকায় ভোলা-বরিশাল আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণ আরএস লাইন অনুযায়ী নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

উক্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করে একাধিকবার আবেদন করা হলেও কার্যত ফলাফল মেলেনি। উভয় জেলার শান্তিপ্রিয় মানুষ ভোলা-বরিশাল সীমানা নির্ধারণ করে ভোলা-বরিশাল সড়ক যোগাযোগ ও গ্যাস লাইন সংযোগের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।

আরও খবর

Sponsered content