জাতীয়

প্রশাসনের ২০৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ

  প্রতিনিধি ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৩:৪০:৫৮ প্রিন্ট সংস্করণ

0Shares

নিজস্ব প্রতিবেদক।।শুধু অবসর দেওয়া কিংবা ওএসডি করা নয়। বিভাগীয় মামলাসহ (ডিপি) বিতর্কিত কর্মকর্তাদের দুর্নীতি খুঁজতেও একটি লম্বা তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে,যা এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।বিগত সরকারের ১৬ বছরে বিতর্কিত নির্বাচনসহ নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত এমন ২০৮ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওই কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এমনই তথ্য।

এরই মধ্যে বৃহস্পতিবারও (২০ ফেব্রুয়ারি) বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ২২ ডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তার আগে বুধবার ওএসডি করা হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের ৩৩ কর্মকর্তাকে।

জানা গেছে,২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রশাসনের বিভাগীয় কমিশনার,জেলা প্রশাসকসহ (ডিসি) যেসব কর্মকর্তা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়েছেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঊর্ধ্বতনদের অনৈতিক নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন,দিনের ভোট রাতে হতে অথবা বিতর্কিত এবং অগ্রহণযোগ্য অবৈধ নির্বাচনকে বৈধ করাতে সহায়তা করেছেন।প্রশাসনের এমন বিতর্কিত ২০৮ জন কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।যারা গত সরকার আমলে বিতর্কিত সেই সব নির্বাচনের সময় বিভাগীয় কমিশনার,ডিসি (রিটার্নিং অফিসার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।এসব কর্মকর্তার মধ্যে কেউ কেউ সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে ইতোমধ্যেই পদোন্নতি পেয়েছেন।বিতর্কিত এসব কর্মকর্তার মধ্যে যাদের চাকরিকাল এরই মধ্যে ২৫ বছর হয়েছে তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেবে সরকার।আর যেসব কর্মকর্তার এখনো চাকরিকাল রয়েছে, সেসব কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন,চাকরির মেয়াদ রয়েছে যাদের তাদের এখনই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যাচ্ছে না।তবে যেসব কর্মকর্তা গত সরকারের অবৈধ নির্দেশ মানার পাশাপাশি নির্বাচনে নির্দিষ্ট প্রার্থীকে জয়ী করার বিনিময়ে বিপুল আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন তাদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তাই নন,তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আছে।তাই ওই সব বিতর্কিত কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুত করে দুদকে পাঠানো হবে। তা ছাড়া সরকারি চাকরি আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে অনির্বাচিত অবৈধ সরকারকে সহযোগিতা করার অভিযোগেও অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই বিভাগীয় মামলা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।মোদ্দাকথা,প্রশাসনে শুদ্ধি প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়,৫ আগস্টের পর থেকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত সিনিয়র সচিব ও সচিব পদের ১৪ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর ও একই পদের ২৩ জন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।পাশাপাশি গ্রেড-১ পদের এক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর ও দুজনকে ওএসডি ছাড়াও ১৯ অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসর ও একই পদের ৫১ কর্মকর্তাকে ওএসডি করে ইতোমধ্যে আদেশ জারি করেছে সরকার।

এদিকে প্রশাসনে ঢালাওভাবে কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর ও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করায় প্রশাসনে স্পষ্ট একটি বিভক্তি তৈরি হচ্ছে বলেও দাবি করেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তা।তিনি বলেন,কোনো কর্মকর্তা অপরাধ করলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। এতে কোনো দ্বিমত নেই।কিন্তু ঢালাওভাবে একটি গোষ্ঠীর সমর্থক চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এটাও কতটা যুক্তিযুক্ত তা কর্তৃপক্ষকে ভাবনায় রাখতে হবে।তিনি বলেন,হঠাৎ একটি সরকার পরিবর্তনের ফলে এমনিতেই ভেতরে ভেতরে প্রশাসনের মধ্যে একটা অস্থিরতা রয়েছে। স্বাভাবিক গতিতে চলছে না প্রশাসনের কার্যক্রম।গণহারে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে প্রশাসনের এই অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে।এতে আস্থাহীনতা,ভীতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা নতুন একটি সরকারের জন্য শুভ ফল বয়ে না আনতেও পারে।যেহেতু এই সরকার রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সংস্কার শুরু করেছে।সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হলে প্রশাসনের এসব কর্মকর্তারই প্রয়োজন হবে।তাই প্রশাসনের মধ্যে উদ্দীপনার বদলে হতাশা,ভীতি,অনিশ্চয়তা তৈরি হলে তা কারও জন্যই সুখকর হবে না।

এদিকে গতকাল বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন,চারজন উপদেষ্টা,মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে সদস্য করে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ২২ জন রিটার্নিং কর্মকর্তাকে (ডিসি) বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন,২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর নির্বাচনগুলোকে আমরা কেউ বলি বিতর্কিত,কেউ বলি অগ্রহণযোগ্য,কেউ বলি দিনের ভোট রাতে ইত্যাদি।রিটার্নিং অফিসারদের সহযোগিতায় ওই তিন নির্বাচন সম্পন্ন করে সরকার।এই সরকার (আওয়ামী লীগ) তিন মেয়াদে থাকার কারণে আজ আমরা এ দুর্বস্থায় পড়েছি।তারা (ওই সময়ের ডিসিরা) অনেক বড় নেগেটিভ ভূমিকা রেখেছিলেন।কোনো একজন ডিসিও বলেননি আমি প্রতিবাদ করব,আমি রিটার্নিং অফিসার থাকব না,আমি রিজাইন করলাম,কাজ করব না।’

সিনিয়র সচিব বলেন,আমরা এরই মধ্যে ৪৩ জনকে (ডিসি) ওএসডি করেছি।যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের কম তাদের ওএসডি করা হয়।আর চাকরির বয়স ২৫ বছরের বেশি হলে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হচ্ছে।এর আগে গত বুধবার ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় প্রশাসনের ৩৩ (বর্তমানে যুগ্ম সচিব) কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে আদেশ জারি করেছে সরকার।’

এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে এমন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়গুলো অশনিসংকেত বহন করছে।তিনি বলেন,সরকার চাইলে যে কাউকে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে,সেটা সাধারণ নাগরিকও হতে পারেন।সরকার তাদের দায়িত্ব দেয় বলেই তারা দায়িত্ব পালন করেন।একজন রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঁচ-সাতটি এলাকার দায়িত্ব থাকতে পারে,হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্র থাকে।একজন রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষে কি এতকিছু দেখভাল করা সম্ভব? ভোটকেন্দ্রের মূল দায়িত্ব প্রিসাইডিং অফিসারের।সেখানে পোলিং এজেন্টসহ অন্যান্য যারা দায়িত্ব পালন করেন সেই কেন্দ্রের দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়।শুধু রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের কারণে এখন যেভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে,সেটা অনায্য-অন্যায়।’

গত বুধবার ওএসডি হয়েছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।তারা বলেন, ‘আমাদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।কারণ সরকারের নির্দেশ ছাড়া কোনো কর্মকর্তার পক্ষেই কোনো নির্দিষ্ট পদে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।সরকারে চাকুরে হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে,আমরা দায়িত্ব পালন করেছি।আমাদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে।যেসব নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, সেসব নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ভোটের কার্যক্রম দেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।কারণ এসব নির্বাচনে যদি কোনো ‘মনোপলি’ হয়ে থাকে, সেটা সিভিল প্রশাসন নয়, প্রশাসনের অন্যান্য যেসব বিভাগ রয়েছে তারা এটা করেছে। সিভিল প্রশাসন সরাসরি কাউকে মারতে বা গ্রেপ্তার করতে পারে না।এ জন্য তাদের আদেশ দিতে হয়।কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা গেছে,সিভিল প্রশাসন নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর করেনি সরকারের দায়িত্বশীল অন্যান্য সংস্থা।’

0Shares

আরও খবর

Sponsered content

0 Shares