ব্যবসা ও বাণিজ্য সংবাদ

পানির গভীরতার দিক থেকে মাতারবাড়ী হবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো কিংবা সিঙ্গাপুর বন্দরের সমতুল্য

  প্রতিনিধি ১৫ এপ্রিল ২০২৩ , ১২:১৪:৩৩ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।পানির গভীরতার দিক থেকে মাতারবাড়ী হবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো কিংবা সিঙ্গাপুর বন্দরের সমতুল্য।বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় বন্দরটি গড়ে তোলা হচ্ছে,যেখানে থাকবে একটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।হারবার এলাকা খনন করে গভীর করা হবে,যাতে বড় কনটেইনার জাহাজ কিংবা ট্যাংক ভিড়তে পারে।ফলে লোহার আকরিক আমদানি করা বা বড় পরিমাণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি সহজ হয়।

এ প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন,জাইকার এমন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পানির গভীরতার দিক থেকে মাতারবাড়ী হবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো কিংবা সিঙ্গাপুর বন্দরের সমতুল্য।’
২০২৭ সালে বন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর মাতারবাড়ী বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাবে।এর বাইরে এটি ভারতের অনুন্নত উত্তর–পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য একটি প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে কাজ করবে।চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ভূমিবেষ্টিত এ রাজ্যগুলো ‘সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত।

জাপান,ভারত ও বাংলাদেশ গত মঙ্গলবার তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। উত্তর–পূর্ব রাজ্যবিষয়ক ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কৃষ্ণা রেড্ডি জাপানের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করার একটি চেষ্টা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে কোয়াড জোট।যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বাইরে চার জাতির এ জোটের অন্য দুই দেশ জাপান ও ভারত।বাংলাদেশের দক্ষিণে নির্মীয়মাণ একটি সমুদ্রবন্দর তাদের কৌশলের একটি অপরিহার্য অংশ হতে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছে নিকেই এশিয়া।

জাপানভিত্তিক এই প্রভাবশালী গণমাধ্যম জানাচ্ছে,টোকিও–সমর্থিত এই মাতারবাড়ী বন্দর গড়ে উঠছে সোনাদিয়ার ঠিক উত্তরে।সোনাদিয়া হলো বঙ্গোপসাগরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান,যেখানে চীন একটি বন্দর গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছিল।ওই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আগে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে,ঢাকা বছর কয়েক আগে ওই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।

বড় শক্তির মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের যে লড়াই চলছে,ঢাকার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ভারত তাতে কৌশলগতভাবে বিজয়ী হয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক তখন বলেছিলেন।এর মাধ্যমে ভারতের বন্ধু জাপানেরও জয় হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।তবে অনেক বিশ্লেষক এখানে কোনো লড়াই দেখেন না।তাঁদের মতে,বাংলাদেশ সরকার শুধু দেখছে কোথা থেকে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে।

মাতারবাড়ী বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে মার্চে জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ভারত সফরের সময়।তাঁর খোলামেলা ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাজেন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মাতারবাড়ী সামনে চলে আসে।

ওই মাসেই জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ইয়েন (১২০ কোটি ডলার) ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে।এর আগেই টোকিও ৩ হাজার ৮৮০ কোটি ইয়েন দেওয়ার কথা জানিয়েছিল।

ভারত সফরের সময় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী কিশিদা বলেন,তাঁর দেশ সংশ্লিষ্ট দুই দেশের সহযোগিতায় বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে ভারতের উত্তর–পূর্ব এলাকায় একটি শিল্পাঞ্চল অবকাঠামো গড়ে তুলবে,যার উদ্দেশ্য হবে ‘পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ বাড়ানো।

মাতারবাড়ী কেবল এসব রাজ্যের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক বন্দর হবে,তাই-ই নয়, এটি তাদের জন্য সবচেয়ে বিচক্ষণ বিকল্পও হবে।কেননা,প্রতিবেশী অন্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারতের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী আনু আনোয়ার নিকেই এশিয়াকে বলেন,চীনের সঙ্গে সোনাদিয়া বন্দর গড়ে তোলার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি, ‘কারণ এ ব্যাপারে ভারতের আপত্তি ছিল, যা দিল্লির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে ঢাকা নাকচ করতে পারেনি।’

তবে আনু আনোয়ার একই সঙ্গে বলেন,ভারত চীনা প্রস্তাবের বিকল্পও কিছু দিতে পারেনি।কারণ,তাদের সেই সম্পদ ছিল না।সুতরাং তারা মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণে জাপানকে স্বাগত জানায়। এ বন্দর বাংলাদেশের স্বার্থ যতটা রক্ষা করবে, ভারতের স্বার্থ তার চেয়ে কম রক্ষা করবে বলে মনে হয় না।’

জাপানের মেইকাই ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তেতসুও কোতানি টোকিওর চিন্তাভাবনার বিশ্লেষণ করেন এভাবে,মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাপানে যে তেল রপ্তানি হয়,তা আসে বঙ্গোপসাগর হয়ে। ফলে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রজায় রাখার লক্ষ্য নিয়ে জাপান এখানে বিনিয়োগ করছে।’

তেতসুও কোতানি আরও বলেন,এ অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ করার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে জাপান ভবিষ্যতে সামরিক সহযোগিতা শুরুর জন্য ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।তাঁর কথায়,যেকোনো সামরিক সহযোগিতা শুরু হয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও মানুষের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে।’

গত সপ্তাহে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর মধ্যকার অনুশীলনে জাপান পর্যবেক্ষক ছিল।

জাইকার কর্মকর্তা বলেন, গত দশকে জাপান বাংলাদেশের জন্য আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বেশ বাড়িয়েছে।প্রতিবছর জাপানে ইয়েনে যত ঋণ দেয়,বাংলাদেশ তার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পায়।বেশির ভাগ অর্থ খরচ হয় সড়ক,সেতু এবং অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামো তৈরিতে।

বন্দর উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাপান মাতারবাড়ীর চেয়ে ভালো আর কোনো স্থানের কথা ভাবতেও পারত না। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি প্রাকৃতিক প্রবেশদ্বার।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘রিয়েল এস্টেটের মতোই ভূরাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে স্থান, স্থান এবং স্থানই হলো সবকিছু। মাতারবাড়ী সেই উদ্দেশ্য পূরণ করে।’

মাইকেল কুগেলম্যান আরও বলেন, দীর্ঘদিনের সাহায্যকারী হিসেবে জাপান মাতারবাড়ীর কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আর সে কারণে পাঁচ বছর আগে বন্দরটি উন্নয়নে তারা অঙ্গীকার করে। মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ একটি যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে।

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘মোদির সরকার ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করলেও অবকাঠামোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে। ঢাকা যাতে বেইজিংয়ের ওপর বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমায়, সে জন্য ওয়াশিংটনও সম্পর্ক জোরদার করতে চায়।’ তিনি ধারণা দেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এদের কাছে ঢাকাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
বাংলাদেশের আরেকটি বন্দর মোংলার উন্নয়নে এখন চীন ও ভারত—এই দুই দেশই তহবিল জোগানোর সুযোগ খুঁজছে।

ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টারের আনু আনোয়ার মনে করেন, বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলতে চীন ও জাপানের আগ্রহ বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কথাই তুলে ধরে। তবে তিনি বলেন, ‘যদিও প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরটি গড়ে তুলতে বাংলাদেশ চীনাদের চেয়ে জাপানি বিনিয়োগ পছন্দ করেছে, তার মানে এই নয় যে দেশটি বন্দরটিকে একটি ভূরাজনৈতিক গুটি হতে দেবে, যাকে এক শক্তি অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।’

প্রথম আলো
তবে ‘বিশাল দেশগুলো বাংলাদেশের বন্দর নিয়ে যুদ্ধে মেতেছে’—এমন ধারণা বাতিল করে দেন ঢাকাভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক অ্যাডাম পিটম্যান। বিষয়টিকে হাস্যকর হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ সংগ্রহ করছে, সেটিই এখানে দেখা যাচ্ছে।

অ্যাডাম পিটম্যান যুক্তি দেন, চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে বাস্তব কোনো আগ্রহ প্রকাশ করার অনেক আগে থেকেই জাপান দেশটিতে বিনিয়োগ করে আসছে। ‘সেই দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটেই মাতারবাড়ী বন্দরের বিষয়টি দেখা উচিত,’ আরও যোগ করেন তিনি।

অ্যাডাম পিটম্যান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কিশিদার খোলামেলা ইন্দো-প্যাসিফিকের ধারণা হয়তো সেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্দীপনা জোগাতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি না যে এটা এখানে জাপানের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত গতিপথকে কোনোভাবে পরিবর্তন করবে।’

আরও খবর

Sponsered content