সারাদেশ

নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে পালিয়ে আসছি-নির্যাতিত গৃহকর্মী রাবেয়া

  প্রতিনিধি ৯ অক্টোবর ২০২২ , ২:০৩:৫৪ প্রিন্ট সংস্করণ

খুলনা প্রতিনিধি।।পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রতিবেশীর মাধ্যমে খুলনার এক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যান রাবেয়া আক্তার (২০) ওরফে আকলিমা। প্রথমে যেতে রাজি না হলেও অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার কথা শুনে রাজি হন তিনি।

তিন বছর পর রাবেয়াকে পাঠানো হয় ওই পুলিশ কর্মকর্তার ছোট মেয়ের বাড়িতে। সেখানে টানা পাঁচ বছর গৃহকর্মীর কাজ করেন। এ সময় তাঁকে প্রতিনিয়ত সইতে হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। শরীরজুড়ে নির্যাতনের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ওই তরুণী।

সামছুল হক স্যার, তাঁর বড় মেয়ে সবাই ভালো ছিল। কিন্তু ছোট মেয়ে ছিল অন্য রকম। প্রতিটা কাজে সময় বেঁধে দিত। একটু দেরি হলে বা ভুল হলেই মারধর, বকাবকি করত। একদিন ওয়ার্ড-রোবের ওপর টিকটিকির মল পাওয়ায় আমাকে মুখ দিয়ে পরিষ্কার করায়।রাবেয়া আক্তার (২০)।রাবেয়ার বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর বারইখালী গ্রামে। বাড়ি ফেরার পর পরিবার থেকে তাঁকে মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালের বিছানায় বসে রাবেয়া আক্তার বলেন, ‘অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে শুনে আমি কাজে যেতে রাজি হয়েছিলাম।কিন্তু মা মারা গেলেও বাড়ি আসতে পারিনি।প্রথম কাজে যাই খুলনার নিরালা আবাসিক এলাকার এস এম সামছুল হকের বাড়িতে।তিনি পুলিশের ওসি (পরিদর্শক) ছিলেন। সেখানে তিন বছর কাজ করার পর তিন মাসের জন্য ওই পুলিশ কর্মকর্তার বড় মেয়ের বাড়িতে কাজে যাই। সেখান থেকে আমাকে ছোট মেয়ের বাড়িতে পাঠানো হয়। তখন থেকেই আমার ওপর নির্যাতন শুরু হয়।’

রাবেয়া বলেন, ‘আমাকে প্রচুর মারধর করত। লাঠি-খুন্তি দিয়ে পেটাত। দেয়ালে মাথা টাক (আঘাত) দিত। সব সময় একটা ভয়ে থাকতাম। কারও জীবন যেন এমন না হয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে পালিয়ে আসছি। আমি আর কিছু চাই না। আমার মা নেই। মায়ের শেষ স্মৃতি একটা নাকফুল আছে ওই বাসায়। আপনারা ওইটা আমাকে এনে দেন।’

রাবেয়া বলেন, পাঁচ বছর ধরে ওই পুলিশ কর্মকর্তার ছোট মেয়ে নারগিস সুলতানার বাসায় তাঁকে ব্যাপক নির্যাতন সইতে হয়েছে। নারগিসের স্বামী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর। নির্যাতন সইতে না পেরে গত বুধবার সকালে ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকার ওই বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন তিনি। ওই দিন সকালেও তাঁকে মারধর করা হয়।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাবেয়ার হাত-পা, মুখমণ্ডল, ঘাড়-পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শর্মী রায় বলেন, ‘ওই মেয়ের সারা শরীরেই ক্ষতচিহ্ন আছে। এগুলো বেশ পুরোনো। শার্প কাটিং কোনো ক্ষত নেই। সবই ব্লাংক হুইপেনের (লাঠিজাতীয় কিছু) আঘাতের চিহ্ন বলে মনে হয়েছে। সে ব্যথার কথা বলছে। সে বেশ দুর্বল। শারীরিকভাবে সে এখন ভালো আছে। তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’

রাবেয়া বলেন, ‘সামছুল হক স্যার, তাঁর বড় মেয়ে সবাই ভালো ছিল। কিন্তু ছোট মেয়ে ছিল অন্য রকম। প্রতিটা কাজে সময় বেঁধে দিত। একটু দেরি হলে বা ভুল হলেই মারধর, বকাবকি করত। একদিন ওয়ার্ডরোবের ওপর টিকটিকির মল পাওয়ায় আমাকে মুখ দিয়ে পরিষ্কার করায়। ওই ম্যাডামদের সঙ্গে স্যারের পোস্টিংয়ের কারণে নীলফামারীর সৈয়দপুর, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, ঢাকার সাভার, রংপুর হয়ে ঢাকার বাসায় কাজ করেছি। এই পাঁচ বছরসহ গত আট বছরে কখনো বাড়ি আসতে পারিনি।’

রাবেয়ার ভাষ্য, তাঁকে কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। পেটে-ভাতে কাজ করাত। বড় করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, এমন শর্তেই নাকি ১২ বছর বয়সে বাড়ি থেকে তাঁকে কাজে পাঠানো হয় বলে তিনি জেনেছেন।

রাবেয়ার বড় বোন হামিদা বেগম বলেন, ‘আমার বাবার দুই বিয়ে। প্রথম ঘরে আমরা চার বোন। পরের ঘরে সাত বোন দুই ভাই। অভাবের কারণে আমি লেখাপড়া করতে পারিনি। ওকে কিছুটা পড়ালেও পরে কাজে পাঠায়। বছরে এক-দুইবার কথা হতো। আমরা জানতাম, ও রংপুরে আছে। ঢাকায় আছে এই কথাও আমাদের জানানো হয়নি।’

রাবেয়ার ছোট চাচা কাঞ্চন মোল্লা বলেন, রাবেয়ার বাবা অসুস্থ হয়ে এখন মৃত্যুশয্যায়। গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তার বাবাকে ফোন করে বলা হয়, রাবেয়া ঢাকার বাসা থেকে পালিয়েছে। কিন্তু আগে জানানোই হয়নি মেয়েটা ঢাকায়। পরে তাকে (রাবেয়া) এখানে দেখে বাড়ির সবাই ভেঙে পড়েন। বিষয়টি ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে জানানো হয়। তিনি এসে চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেন এবং ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি তা মানেননি। এ নির্যাতনের বিচার চান তাঁরা।

কাঞ্চন মোল্লার দেওয়া তথ্য ও মুঠোফোন নম্বর অনুযায়ী ফোন করা হলে পরিচয় পাওয়া যায় সামছুল হকের। তিনি সর্বশেষ বাগেরহাটের শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে অবসরে যান। বর্তমানে খুলনায় থাকেন।

অভিযোগের বিষয়ে সামছুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সে আমার মেয়ের বাসায় কাজ করত। গত বুধবার সে আমার ছোট মেয়ের বাসা থেকে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় মিরপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। সে বাড়ি এসেছে খবর পেয়ে আমি মোরেলগঞ্জ যাই। সেখানে গিয়ে শুনেছি, আমার মেয়ে রাবেয়াকে মারধর করেছে। তাই মানবিক কারণে তার চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকাও দিয়ে এসেছি। আমাদের এখানে সে যত দিন ছিল, মেয়ের মতোই ছিল।’

এ বিষয়ে জেলা পুলিশের গণমাধ্যম শাখার সমন্বয়ক পরিদর্শক এস এম আশরাফুল আলম বলেন, খবর পেয়ে নির্যাতনের শিকার ওই তরুণীর খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। তাঁর বাবাও গুরুতর অসুস্থ। মেয়েটিও চিকিৎসাধীন। তাঁর পরিবারের কেউ অভিযোগ দিলে সেই অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও খবর

Sponsered content