সম্পাদকীয়

নির্বাচনের আগে মিডিয়ার রায়: আইন ভাঙা বয়ান,নির্বাচন কমিশনের নীরবতা ও ইতিহাস ভুলে যাওয়ার অপরাধ

  প্রতিনিধি ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৩:২৯:১৫ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।নির্বাচন হয়নি,ভোটাররা রায় দেননি—কিন্তু কিছু সংবাদমাধ্যম ইতোমধ্যেই রায় লিখে ফেলেছে।এটি শুধু সাংবাদিকতার সীমালঙ্ঘন নয়; এটি সরাসরি সংবিধান, নির্বাচন আইন ও গণতান্ত্রিক নৈতিকতার সঙ্গে সংঘর্ষ। নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে ‘বিজয়ী’ বা ‘সম্পূর্ণ বৈধ’ হিসেবে উপস্থাপন করা সংবাদ নয়—এটি রাজনৈতিক বয়ান।

আরও বিপজ্জনক হলো—এই বয়ান নির্মাণে আইনের নির্দিষ্ট ধারা উপেক্ষা,নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বকে পাশ কাটানো,এবং ইতিহাসের নথিভুক্ত অপরাধকে বিস্মৃত করার প্রবণতা স্পষ্ট।

আইন কী বলে—স্পষ্ট ধারা, অস্পষ্ট ব্যাখ্যা নয়
বাংলাদেশের আইন এখানে একেবারেই পরিষ্কার।
বাংলাদেশ সংবিধান,অনুচ্ছেদ ৬৬(২)(ঘ):

> নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি আইন দ্বারা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য।

Representation of the People Order (RPO), ১৯৭২ – ধারা ১২(১)(গ):

> কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডিত হলে, দণ্ড ভোগ শেষ হওয়ার পর ৫ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন,২০০৪ – ধারা ২৭ ও ২৬:

> অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন গুরুতর অপরাধ এবং এতে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে রাজনৈতিক অধিকার সীমাবদ্ধ হয়।

আইনজীবীদের বক্তব্য একবাক্যে—খালাস মানেই রাজনৈতিক অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে আসা নয়।আদালত যদি স্পষ্টভাবে ‘রাজনৈতিক অধিকার পুনর্বহাল’-এর নির্দেশ না দেন,তবে RPO অনুযায়ী ৫ বছরের বাধা কার্যকর থাকে।সব মামলায় একই দিনে খালাস হয়নি—এই সত্য উপেক্ষা করে ‘সম্পূর্ণ ক্লিন’ বয়ান তৈরি আইনবিরোধী বিভ্রান্তি।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব: নীরবতা কি ব্যর্থতা নয়?

নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো—

প্রতিটি মামলার রায়,খালাসের তারিখ ও সাজা স্থগিতের আদেশ পৃথকভাবে যাচাই করা

মনোনয়ন যাচাইয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় কপি ছাড়া সিদ্ধান্ত না নেওয়া

আইনের প্রশ্নে রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করা

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে—আইনি জটিলতা পরিষ্কার না করেই একটি রাজনৈতিক বয়ান জনপরিসরে প্রাধান্য পাচ্ছে। কমিশনের এই নীরবতা প্রশ্ন তোলে—এটি কি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা,নাকি আগাম রাজনৈতিক বাস্তবতায় সমঝোতা?

নির্বাচন কমিশন যদি নিজ দায়িত্বে আইনের ব্যাখ্যা স্পষ্ট না করে,তবে মিডিয়ার আগাম রায় কার্যত কমিশনের কর্তৃত্বকে গ্রাস করে নেয়।এটি গণতন্ত্রের জন্য অশুভ।

ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না: ২০০১–২০০৮-এর শিরোনামগুলো কী বলেছিল

আজ যাকে ‘পরিষ্কার রাজনৈতিক নেতা’ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে,তার অতীত নিয়ে এই দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোই একসময় ধারাবাহিক শিরোনাম করেছে। স্মৃতি সতেজ করা জরুরি:

“হাওয়া ভবন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা: প্রশাসনে অদৃশ্য ক্ষমতার বলয়”

“তারেক রহমানের প্রভাব: নিয়োগ,বদলি ও টেন্ডারে অলিখিত নির্দেশ”

“ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ,তদন্তের দাবি”

“দুর্নীতি দমন কমিশনের নথিতে তারেক রহমান”

“রাজনীতির আড়ালে সমান্তরাল অর্থনীতি”

এই শিরোনামগুলো কোনো দলীয় লিফলেট নয়—দেশের শীর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ।আজ সেই একই সংবাদমাধ্যম যদি ইতিহাস ভুলে ‘নৈতিক পুনর্জন্ম’-এর গল্প শোনায়,তবে প্রশ্ন ওঠে—এটি সাংবাদিকতার আত্মসমালোচনা, নাকি সুবিধাজনক বিস্মৃতি?

সম্পাদকীয় মতামত বনাম আগাম রায়

মতামত দেওয়ার অধিকার সম্পাদকীয়র আছে—কিন্তু আইনের সীমা লঙ্ঘন করে আগাম রায় ঘোষণার অধিকার নেই। নির্বাচন হবে ভোটে,বৈধতা নির্ধারিত হবে আইনে।এই দুইয়ের জায়গা দখল করে মিডিয়া যদি রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নে নেমে পড়ে, তবে তা সাংবাদিকতার অবক্ষয়।

উপসংহার: আইনকে পাশ কাটিয়ে গণতন্ত্র চলে না

রায় দেবে ভোটার।বৈধতা নির্ধারণ করবে আদালত ও নির্বাচন কমিশন।সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব—এই সত্য আড়াল না করা। ইতিহাস,আইন ও নৈতিকতা উপেক্ষা করে আগাম বিজয় ঘোষণা করলে তা শুধু পক্ষপাত নয়—গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতারণা।

আজ কঠোর ভাষা প্রয়োজন,কারণ নীরবতা অপরাধকে বৈধতা দেয়।

আরও খবর

Sponsered content