সারাদেশ

নারী চালকের সংখ্যা বাড়লে গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের হয়রানিও কমবে-চালক, মুক্তি রানী

  প্রতিনিধি ২৭ এপ্রিল ২০২৩ , ২:৪২:০৮ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ভাই কই যাইবেন? আশুলিয়া, জিরাবো, জামগড়া… ও আপা কই যাইবেন?নরসিংহপুর,নবীনগর, বাইপাইল’—মুক্তি রানী লেগুনাচালকের আসনে বসেই যাত্রীদের এভাবে ডাকতে থাকেন।কোনো কোনো যাত্রী নারী চালককে দেখে খানিকটা থমকে যান।আবার কেউ কেউ সরাসরি জানতে চান তিনিই লেগুনা চালাবেন কি না!

তবে নিয়মিত চলাচল করা যাত্রীরা দৃঢ় কণ্ঠেই বললেন,এই দিদি গাড়ি খুব ভালো চালান।ব্যস্ত সড়কে দক্ষ চালক না হলে তো গাড়ি চালাতে পারতেন না।

চালকের আসনে বসা মুক্তি রানীর গলায় ঝুলছে লেমিনেটিং করা ড্রাইভিং লাইসেন্স।বললেন,যাত্রী খুঁইজ্যা আনা, যাত্রীর কাছ থেইক্যা ভাড়া তোলা সব আমিই করি।’

প্রায় এক বছর ধরে সাভারের আশুলিয়া এলাকায় লেগুনা চালাচ্ছেন মুক্তি রানী।এর আগে গাড়ি চালানো ও লাইসেন্স পেতে লেগেছে দুই বছর।দিনে যাত্রীভেদে কোনো দিন ৫০০ টাকা আবার কখনো আরও কম বা বেশি টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের প্রত্যন্ত গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ায় স্কুলে গেলেও এসএসসি পর্যন্তও পড়তে পারেননি মুক্তি রানী।অভাবের কারণেই তাঁর বাবা সাভারে চলে এসেছিলেন। মাত্র ১২ বা ১৩ বছর বয়সে পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন,বয়স কম বলে কারখানায় বিদেশি ক্রেতারা এলে মুক্তি রানীকে লুকিয়ে রাখা হতো।কাজ করে দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন একসময়।

কিন্তু মুক্তি রানী বললেন,পোশাকশিল্পের কাজে গালাগালি শুনতেই হতো।পরিশ্রমও ছিল।এখন গালিগালাজের বালাই নেই। মন চাইলে লেগুনা নিয়ে বের হন,মন না চাইলে বের হন না।

গতকাল বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুক্তি রানী সংসারের কাজ শেষ করে গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে তাঁর জীবনের গল্প শোনালেন।বললেন,এমনও অনেক দিন থাকে যখন লেগুনার ১০ থেকে ১২ জন যাত্রীর সবাই পুরুষ,আর চালকের আসনে তিনি একা নারী।বললেন,গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পর থেকে তাঁর মাথায় থাকে যাত্রী,নিজের আর লেগুনার নিরাপত্তার কথা।মুক্তি রানী বললেন,যাত্রীরে গাড়িতে উঠাইছি, নিরাপদে নামাইতে পারি তার চেষ্টা করি সব সময়।নিজের জানের কথাও ভাবতে হয়।’

মুক্তি রানীর স্বামী তপন চন্দ্র বিশ্বাস আশুলিয়ায় একটি পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করেন।আশুলিয়ার উত্তর গাজীরচট (তালতলা) এলাকায় এক কক্ষের বাসায় থাকেন এই দম্পতি। এক ছেলে পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে।আর ছয় বছর বয়সী মেয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে।গাড়ি চালানোর জন্য মুক্তি রানী ভোরে বের হন।জিনিসপত্রের দাম বাড়াসহ দেখার কেউ নেই বলে ছেলেমেয়েদের দাদার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওখানেই বড় হচ্ছে ওরা।ছেলেমেয়েদের খরচ হিসেবে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পাঠান।মাঝেমধ্যে গিয়ে ছেলেমেয়েদের দেখে আসেন অথবা ছেলেমেয়েরা এসে দুই–এক দিন থাকে মা–বাবার সঙ্গে।ব্যস্ত মহাসড়কে গাড়ি চালানোর সময় মুক্তি রানীর চোখেমুখে কঠোর একটি ভাব থাকলেও ছেলেমেয়েদের কথা বলার সময় এ মায়ের দুই চোখ ছলছল করতে থাকে। বললেন,ছেলেমেয়েরা দূরে থাকে।মায়ের বুকটা খালি খালি লাগে।’

মুক্তি রানীর ঘরে লেমিনেটিং করে ছেলে আর মেয়ের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন।সে ছবিও অনেক আগের।একটি ছোট মিনিস্টার স্মার্ট টেলিভিশন,ছোট একটি ফ্রিজ,ক্যাসেট প্লেয়ার,কাপড় রাখার জন্য ওয়ার্ডরোব,ড্রেসিং টেবিলের ওপর একটি সিঁদুরের কৌটা,চিরুনি,ক্লিপ,একটি শেলফে কিছু হাঁড়ি পাতিল—এই নিয়েই বলতে গেলে মুক্তি রানীর সংসার।

মুক্তি রানীর দিন শুরু হয় ভোর চারটা বা পাঁচটার সময়। দিনের রান্না শেষ করে মুখে কিছু দিয়েই বের হন লেগুনা নিয়ে।দুপুরে মাঝেমধ্যে ঘরে ফিরে দুপুরের খাবার খান।লেগুনা চালিয়ে খুব বেশি খিদে লাগলে একটি ছোট কেক আর এক গ্লাস আখের রস খান।মুক্তি রানীর জীবনে বিলাসিতা বলতে গেলে এইটুকুই।বললেন,পুরুষ চালকেরা গাড়ি চালানোর ফাঁকে আড্ডা দেন,চা,সিগারেট বা অন্য কিছু খান।আমি এইগুলা করি না।বাইরে কিছু খাইতে গেলেও মনে হয়,এই টাকা খরচ না হইলে ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু ভালোমন্দ কিনতে পারব।’ মুক্তি রানীর সাজসজ্জা বলতে সুতির সালোয়ার কামিজ আর ওড়না পরেন।গলায় একটি তুলসীর মালা আর কানে ছোট দুটি দুল।সিঁথিতে সিঁদুর আর কপালে টিপ।

মুক্তি রানীর বাবা যতীন চন্দ্র দাশ প্রথমে রিকশা চালাতেন, পরে অটো চালানো শুরু করেছিলেন।ট্রাকের ধাক্কায় এ অটোতেই তিনি মারা গেছেন দেড় বছর আগে।মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত মুক্তি রানীকে গাড়ি চালানোর বিষয়ে সব থেকে বেশি সাহস দিয়েছেন বাবা।মুক্তি রানীর দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই বাবার রেখে যাওয়া অটো চালান।আরেক ভাই লেগুনা চালাতেন,এখন ট্রাক চালান।বাবা,ভাই এবং স্বামীর সহযোগিতায় মুক্তি রানীও এখন লেগুনার চালক।

ট্রাকচালক ভাই সজীব চন্দ্র দাশ নিজে লেগুনা চালানো শিখিয়েছেন মুক্তি রানীকে।এই ভাইও মুক্তি রানীর বাসার কাছেই থাকেন।তাঁর বোন ভালোই লেগুনা চালান বলে তৃপ্তির হাসি দিলেন।বললেন,আপন বোন,ভালোমতো ট্রেনিং দিছি। গাড়ি দিয়া রাস্তায় তো আর এমনি নামতে দিতে পারি না। আমি গাড়ি চালাই,আমি জানি এইটা কতটা কঠিন কাজ। প্রতি সেকেন্ডের দাম আছে।হিসাবে গণ্ডগোল হইলেই তো দুর্ঘটনা ঘটব।’

সজীব বেশ গর্ব করেই বললেন,বাবা গাড়ি চালাইত।দুই ভাই গাড়ি চালাই।বোনও এখন গাড়ি চালায়।বোন যখন গাড়ি চালানো শুরু করল,তখন অনেক কুকথা শুনছে।হাল ছাড়ি নাই।বোনের গাড়িটা ভাঙাচোরা,ম্যানুয়াল গাড়ি চালাইতে অনেক কষ্ট।তাই বোনটার কষ্টটা একটু বেশি হয়।জানালেন, মুক্তি রানী তাঁর কাছে ট্রাক চালানোও শেখার চেষ্টা করছেন।

লেগুনা চালাতে বাবা,স্বামী ও ভাইদের কাছ থেকে সমর্থন পেলেও মা সন্ধ্যা রানী দাশ মেয়ের লেগুনা চালানো পছন্দ করেন না।মুক্তি রানী বললেন,তাঁর মা সারাক্ষণ মেয়ে রাস্তাঘাটে কখন কোন বিপদে পড়ে—এ ভয়ে থাকেন সারাক্ষণ।

মাসের ১০ তারিখের পর যে শুক্রবার তার অপেক্ষায় থাকেন মুক্তি রানী।অফিসফেরত যাত্রীর পাশাপাশি মুক্তি রানীর লেগুনার যাত্রীদের বেশির ভাগই পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করা শ্রমিক।তাঁরা বেতন পাওয়ার পর শুক্রবারে বাজার করতে,ঘুরতে,সিনেমা দেখতে বের হন।তখন যাত্রীর চাপটা বাড়ে।

ভাড়ায় লেগুনা চালাতে গেলে দিনে লেগুনা মালিককে বেশ বড় অঙ্কের টাকা জমা দিতে হয়।তাই মুক্তি রানী দেড় লাখ টাকায় লক্কড়ঝক্কড় একটি লেগুনা কিনে নিয়েছেন।এনজিও থেকে ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি সুদেও টাকা ধার করতে হয়েছে।আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিতে হয়েছে।সুদে যে টাকা ধার নিয়েছেন সপ্তাহে ১ হাজার ১০০ টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে।পাঁচ ছয়টি কিস্তি এখনো বাকি। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করা প্রায় ৭০ হাজার টাকা এখনো শোধ করতে পারেননি।

মুক্তি রানী যে বাসায় থাকেন,সেখানে তিনটি পরিবার ভাগাভাগি করে থাকে।মুক্তি রানীর ভাগে পড়েছে একটি ঘর, একজন কোনো রকমে দাঁড়াতে পারে—এমন একটি বারান্দা, ছোট একটি শৌচাগার আর ভাগে রান্না করার জন্য গ্যাসের চুলা।এ বাবদ মাসিক ভাড়া দিতে হয় প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা।ডাল,আলুভর্তা,মাঝেমধ্যে মাছ বা মাংস এ খাওয়া বাবদও খরচ আছে।চাল কিনতেই চলে যায় অনেক টাকা।

ছেলে-মেয়েদের খরচের জন্য গ্রামে টাকা পাঠাতে হয়।ঋণ শোধের দায় তো আছেই।পুরোনো লেগুনা,তাই গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া,তেলের খরচসহ অন্যান্য খরচও একেবারে কম নয়।মুক্তি রানী বাড়িতে থাকা নিজের মা ও ভাই এর জন্যও কিছু টাকা পাঠানোর চেষ্টা করেন।

মুক্তি রানী বললেন,স্বামী কম বেতনে চাকরি করেন।দুজনের আয় দিয়ে মাস পার হয় কোনোভাবে।শখ–আহ্লাদ পূরণ করা সম্ভব হয় না।তবে আশায় আছি একসময় শখ–আহ্লাদও পূরণ হইব।’

নিজের আয় করা টাকা কীভাবে কোথায় খরচ করবেন—এ বিষয়ে মুক্তি রানী নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন,তাঁর স্বামী কখনোই এ নিয়ে কিছু বলেন না বলেও জানালেন মুক্তি রানী।

মুক্তি রানী বললেন,অনেক সময় বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়।তখন মনে একটু ভয় কাজ করে।যাত্রীদের সবাই ভালো হবেন তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই।অনেকেই জানতে চান,তিনি রিজার্ভ বা চুক্তিতে গাড়ি চালাবেন কি না। তবে এসব চুক্তি বা শর্তে রাজি হন না তিনি।

লেগুনার চালকের আসনে নারী—এ দৃশ্য দেখে এখনো অভ্যস্ত নন মানুষ।রিকশাচালক,মোটরসাইকেলচালকদের অনেকেই বাজে কথা শোনানোর পাশাপাশি বাজে অঙ্গভঙ্গিও করেন। অনেকে মুক্তি রানীর লেগুনার পাশে এসে বা একটু সামনে গিয়ে তাঁদের গাড়ির গতি কমিয়ে মুখ ঘুরিয়ে মুক্তি রানীকে দেখতে থাকেন।এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে,ব্যস্ত সড়কে সহজেই যানজট লেগে যায়।তবে প্রায় এক বছরে এগুলো সবই মুক্তি রানীর গা সওয়া হয়ে গেছে।

দীর্ঘ সময় গাড়ি চালাতে গিয়ে শৌচাগারের সমস্যায় মুক্তি রানীকে বেগ পেতে হয়।নারী বলেই যেখানে–সেখানে যেতে পারেন না।কাছাকাছি তেল ও পেট্রলপাম্প ভালো না থাকলে প্রস্রাব-পায়খানা চেপে রাখতে হয়।অনেক সময় বাধ্য হন গাড়ি চালানো বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে।

গাড়ি চালাতে গিয়ে ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি হতেই পারে।তবে আশপাশের মানুষ যখন দেখেন গাড়িচালক নারী তখন ইচ্ছে করেই সব দোষ মুক্তি রানীর ঘাড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেক সময় যাত্রীরা কম ভাড়া দিতে চান।রাস্তায় অকারণেই মানুষ দিদি,বৌদি বলে ডাকতে থাকেন।তবে লেগুনার অন্য পুরুষ চালক বা যাত্রী বিশেষ করে পুরুষ যাত্রীদের কাছ থেকেই বেশি সহায়তা পান বলেও জানালেন মুক্তি রানী। কখনো নিজের ভুলে আবার কখনো অন্য চালকদের ভুলে এ পর্যন্ত দুই একবার দুর্ঘটনা ঘটেছে তাও অকপটে স্বীকার করলেন মুক্তি রানী।

লেগুনায় মুক্তি রানীর সহায়তাকারী কেউ নেই।যাত্রীরা নেমে যাওয়ার সময় মুক্তি রানীর হাতে ভাড়া দিয়ে যান।
চলতি পথে পরিচিতজনেরা মুক্তি রানীর সঙ্গে কথা বলেন, কুশল জানতে চান।মুক্তি রানী অন্য নারীদের গাড়ি চালানো শেখাতে চান।মুঠোফোনে কথা বলছেন মুক্তি রানী
ছেলেমেয়েরা দাদার বাড়িতে বড় হচ্ছে।মুক্তি রানী ছেলে-মেয়েদের ছবি লেমিনেটিং করে ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছেন
মুক্তি রানীর মতে,তিনি এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন।

মুক্তি রানী গাড়ির চাকা লাগানো বা কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তা মেরামত করা শিখেছেন।তবে মুক্তি রানী বললেন, ‘পুরুষেরা গাড়ির নিচে চিৎ হইয়্যা শুইয়্যা চাকা লাগাইতে পারলেও আমি তা করতে পারি না।তাই গাড়ির মিস্ত্রির পেছনে টাকা খরচ করতে হয়।’

জাতীয় পরিচয়পত্রে মুক্তি রানীর বয়স প্রায় ১২ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।আগে বিষয়টি তেমন সমস্যার না হলেও এখন ভালো কোনো কোম্পানি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি বয়সের জন্যই চালক পদে আবেদন করতে পারছেন না মুক্তি রানী।

মুক্তি রানী বললেন,গাড়ি চালাইতে দুই চোখ,ব্রেন,পা-সবকিছু একসঙ্গে সচল রাখতে হয়।মাঝেমধ্যে মনে হয় গাড়ি চালানোর চাইতে মাটি কাটা মনে হয় সহজ ছিল।

মানুষের বাজে কথা তো শুনতেই হয়। তারপরও এ পেশাতেই থাকতে চাই।একটি নতুন লেগুনা কিনেছেন এমন স্বপ্ন প্রায়ই দেখেন মুক্তি রানী।অন্য নারীরাও যাতে এ পেশায় আসতে পারেন তাই তিনি অন্য নারীদের গাড়ি চালানো শেখাতে চান। তাঁর মতে,নারী চালকের সংখ্যা বাড়লে গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের হয়রানিও কমবে।গাড়ি চালানোর পাশাপাশি মুক্তি রানী চান,ছেলেমেয়েদের মনের মতো করে মানুষ করবেন।

আরও খবর

Sponsered content