আন্তর্জাতিক

দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি শিশুকে বড় করতে মাথাপিছু জিডিপির ৭.৭৯ শতাংশই ব্যয় হয়ে যায়!

  প্রতিনিধি ২৪ মে ২০২৩ , ৪:০৭:১৬ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।জন্মের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছর) হওয়া পর্যন্ত সন্তানের পেছনে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়ে থাকে দক্ষিণ কোরিয়ায়।সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে,জন্মহার নিম্নগামী হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া যে ‘জনসংখ্যা–সংকটে’ পড়েছে তার বড় কারণ এটি।

গবেষণাটি করেছে বেইজিংভিত্তিক ইউওয়া পপুলেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউট। বিশ্বে জনসংখ্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করে।এ বছরের গবেষণা প্রতিবেদনে সন্তান লালনপালনের ব্যয় নিয়ে যে তালিকা করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে,দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি শিশুকে বড় করতে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশই ব্যয় হয়ে যায়।

অধিকাংশ পরিবারের আয়ের সিংহভাগ সন্তানদের পড়াতেই শেষ হয়ে যায়।দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা খাতে প্রতিযোগিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।পার্ক সাইং–ইন, অর্থনীতিবিদ, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

দক্ষিণ কোরিয়ার পরের অবস্থান চীনের।চীনে একটি শিশুকে বড় করতে মাথাপিছু জিডিপির ৬ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যয় হয়ে যায়।চীনের পরে আছে জার্মানি।জার্মানিতে সন্তান লালনপালনের ব্যয় মাথাপিছু জিডিপির ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।আর চতুর্থ স্থানে থাকা ফ্রান্সে তা ২ দশমিক ২৪।

জন্মহার কমছেই:-
দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের দশম বৃহৎ অর্থনীতি।দেশটিতে একদিকে যেমন সন্তান লালনপালনের ব্যয় বাড়ছে,তেমনি জন্মহারও দিন দিন কমছে।গত মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারি হিসাবে, দেশটির গড় জন্মহার দশমিক ৭৮।এর অর্থ,১০০ নারী জীবনে গড়ে ৭৮টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার বিশ্বে সবচেয়ে কম।এর মানে জনসংখ্যা বিবেচনায় দেশটিতে শিশুর জন্ম বিশ্বে সবচেয়ে কম।তবে ২০০০ সালেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।ওই বছরে দেশটিতে জন্মহার ছিল ১ দশমিক ৪৮।এর আগে ১৯৮০ সালে ২ দশমিক ৮২ ও ১৯৬০ সালে ছিল ৫ দশমিক ৯৫।
দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার বিশ্বে সবচেয়ে কম।এর অর্থ জনসংখ্যা বিবেচনায় দেশটিতে শিশুর জন্ম বিশ্বে সবচেয়ে কম। তবে ২০০০ সালেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।ওই বছরে দেশটিতে জন্মহার ছিল ১ দশমিক ৪৮।এর আগে ১৯৮০ সালে ২ দশমিক ৮২ ও ১৯৬০ সালে ছিল ৫ দশমিক ৯৫।

বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করছেন জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞরা।তাঁরা বলছেন,জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে দেশটির জন্মহার অন্তত ২ দশমিক ১–এর নিচে নামতে দেওয়া ঠিক হবে না।এটা করতে না পারলে জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনতে অন্য দেশ থেকে অভিবাসীদের দেশে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে।

সন্তান লালনপালনে দক্ষিণ কোরিয়ার অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে শিশুদের স্কুলে পড়াতে।সন্তানকে সরকারি স্কুলে পড়াতে না পারলে ব্যয় সবচেয়ে বেশি হয়।২০২২ সালের এক হিসাবে,বেসরকারি ‘ক্র্যাম’ স্কুলে একটি শিশুর পেছনে মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়।

ক্র্যাম স্কুল দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘হাগওন’ নামে পরিচিত। শিশুদের বয়স চার হলেই তাদের হাগওনে ভর্তি করানো হয়। মূলত শৈশবে ইংরেজিতে দক্ষ করে তুলতে শিশুদের এসব স্কুলে ভর্তি করা হয়।

হান ইয়ে জুং নামে দেশটির একজন আইনজীবীর ৩১ মাস বয়সী একটি কন্যাসন্তান আছে।তিনি বলছেন,কোরিয়ার সমাজে শিক্ষাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।বেশির ভাগ পরিবারেই নিয়মিত স্কুলে পাঠদানের বাইরে সহায়ক বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে শিশুদের পাঠানো স্বাভাবিক ব্যাপার।’

নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি ভালো একটি স্কুলে শিশুকে ভর্তি করার কারণ,যাতে তারা পরীক্ষায় ভালো করে ও সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়টিতেই ভর্তি হতে পারে।ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চাকরি পেতে গুরুত্বপূর্ণ।
হান ইয়ে জুং, আইনজীবী ও অভিভাবক।

এক সন্তানের মা হান ইয়ে জুং বলেন,রাজধানী সিউলে শিশুদের হাগওনে ভর্তি করার চল এখন বেশি।ইংরেজি শিক্ষার এসব কিন্ডারগার্টেনে পড়াতে প্রতি মাসে শিশুদের জন্য অনেক ব্যয় করতে হয়।কারণ,মনে করা হয় শৈশবে শিশুদের ইংরেজি শেখার উপযুক্ত সময়।এ দক্ষতা খুব দরকার।’

অভিভাবকেরা যে নিয়মিত স্কুল শেষে হাগওনে সন্তানদের পাঠান,এর পেছনে আরও একটি কারণ আছে।সেটি হলো দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা বেশি।এ জন্য তাঁরা শিশুকে সেভাবে সময় দিতে পারেন না।আর হাগওনে শিক্ষাদানের পাশাপাশি শিশুদের দেখভালও করা হয়।

ইংরেজি–গণিতে গুরুত্ব:-
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রীড়া,সংগীতসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোও শিক্ষা দেওয়া হয়।কিন্তু হান ইয়ে জুং বলেন, ইংরেজি ও গণিতে গুরুত্ব দিয়েই মূলত শিশুদের পাঠদান করা হয়।কারণ,ভালো একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতায় এই দুই বিষয়ে শিশুদের দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়।ভালো উচ্চবিদ্যালয় মানে এরপর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়।তারপর সেখান থেকে পাস করে ভালো চাকরি।

হান ইয়ে জুং বলেন,নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি ভালো একটি স্কুলে শিশুকে ভর্তি করার কারণ,যাতে করে তারা পরীক্ষায় ভালো করে এবং সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়টিতেই ভর্তি হতে পারে;অর্থাৎ, ভালো একটি চাকরির নিশ্চয়তা। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চাকরি পেতে গুরুত্বপূর্ণ।’

দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদপত্র চোশুন ইলবোর এক সম্পাদকীয় কলামে বলা হচ্ছে,শিশুদের শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকেরা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন।তাঁদের উদ্বেগকে দুর্বলতা মনে করে ফায়দা নিচ্ছে স্কুলগুলো।আর তাঁদের উদ্বেগকে ব্যবহার করে শিশুদের শিক্ষার জন্য বাড়তি অর্থ আদায়ও করছে।
সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন অর্থনীতিবিদ পার্ক সাইং–ইন।তিনিও এ বিষয়ে একমত যে অধিকাংশ পরিবারের আয়ের সিংহভাগ সন্তানদের পড়াতেই শেষ হয়ে যায়।তবে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের এমন ‘প্রতিযোগিতা’ তরুণদের জন্য ইতিবাচক বিষয় নয় বলেই মনে করেন তিনি।

পার্ক সাইং বলছেন,দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা খাতে এ ধরনের প্রতিযোগিতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।’

দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে স্কুলগুলো
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদপত্র চোশুন ইলবোর এক সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়,শিশুদের শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকেরা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন।তাঁদের উদ্বেগকে দুর্বলতা ভেবে ফায়দা নিচ্ছে স্কুলগুলো।আর তাঁদের উদ্বেগকে ব্যবহার করে শিশুদের শিক্ষার জন্য বাড়তি অর্থ আদায়ও করছে।

সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়,বছরের পর বছর সন্তানের শিক্ষার জন্য বাড়তি ব্যয় করতে করতে অভিভাবকেরা ক্লান্ত। দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার যে কমবে,এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।’

পার্ক সাইং-ইন আশাবাদী,দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন আসবে।শৈশবে একটি শিশু বাড়তি পড়াশোনার চাপে পড়বে না;বরং শৈশব উপভোগ করার সুযোগ পাবে শিশুরা।

পরিবর্তন অদূর ভবিষ্যতে হবে না,মানছেন পার্ক সাইং।তবে তিনি আশাবাদী,একদিন পরিবর্তন আসবেই।আমিও এটা বিশ্বাস করি,ভালো মানের শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু আমিসহ এ দেশের অনেকে মনে করেন বেসরকারি শিক্ষা খাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।এর লাগাম টানা প্রয়োজন।’

আরও খবর

Sponsered content