অর্থনীতি

এবারের পর্বের ‘বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতায় টিকতে পারবে বাংলাদেশ?

  প্রতিনিধি ১৬ এপ্রিল ২০২৩ , ৬:২০:৫৮ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।এবারের পর্বের ‘বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতায় টিকতে পারবে বাংলাদেশ?বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার মধ্যে এক বা দুইবছর হয়ত কঠিন সময় পার করতে হবে,তবে প্রাণবন্ত বেসরকারি খাত সেই বিপদ উৎরে বাংলাদেশকে ঠিকই এগিয়ে নেবে বলে আশাবাদী অর্থনীতিবিদ ফরেস্ট কুকসন।

গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দেখা এই মার্কিন গবেষক বলছেন,আমি খুবই আশাবাদী, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, রপ্তানিকারকদের শক্তি,রেমিটেন্স এবং পোশাক খাত অর্থনীতিকে আগামী ৫-১০ বছর খুব ভালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

ফরেস্‌ট কুকসন ঢাকায় ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কারের কাজেও তিনি যুক্ত ছিলেন,যা ছিল মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে বাংলাদেশের যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

১৯৬১ সালে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করে পরে সেখানে শিক্ষকতাও করেছেন কুকসন। গত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে থেকে অর্থনীতির গবেষক ও পরামর্শক হিসেবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে যোগ দিয়ে তিনি কথা বলেছেন বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভালো-মন্দ বিভিন্ন দিক নিয়ে।এবারের পর্বের ‘বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতায় টিকতে পারবে বাংলাদেশ?”

কঠিন সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী কুকসন
বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে ‘খুব আশাবাদী’ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে কুকসন বলেন,আমি মনে করি,বাংলাদেশের পোশাক খাত বেশ শক্তিশালী এবং এটা খুব দ্রুত প্রসারিত হয়েছে। এখানে হয়ত এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় একটু কঠিন সময় যেতে পারে।

“অবশ্য ‍রপ্তানি প্রবৃদ্ধির বিষয়টি অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশগুলোর অবস্থার সঙ্গে খুব বেশি সম্পৃক্ত।উন্নত দেশগুলো যদি দীর্ঘ মন্দার দিকে যায়,তাহলে বাংলাদেশের সামনে খারাপই আছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ আর ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের মত নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে,তাহলে বাংলাদেশও ভালো করতে পারবে বলে আশাবাদী কুকসন।

তিনি বলেন,আমাদের রয়েছে মুক্ত অর্থনীতি।জনগণের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার অদম্য শক্তি রয়েছে।আর রয়েছে খুবই দুর্বল একটি কর কাঠামো এবং খুবই দুর্বল নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা।সেটা পরিকল্পনার কারণেই হোক,কিংবা দুর্ঘটনাবশত।”

দুর্বল কর কাঠামো এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাকে কেন অর্থনীতির জন্য ভালো বলছেন কুকসন?তার ব্যাখ্যা, “অনেক বেশি কর আদায়ের আকাঙ্খা অর্থনীতিকে সাহায্য করার চেয়ে সম্ভবত ক্ষতি বেশি করে।কেন আপনি জনগণকে ইচ্ছামত ব্যবহার করতে না দিয়ে তার কাছ ১০০ টাকা নেবেন এবং সরকারকে খরচ দেবেন?

“ আপনি হয়ত মনে করেন সরকার টাকাটা ভালোভাবে খরচ করছে।কিন্তু একজন বাংলাদেশিও মনে করে না যে,সরকার খুব ভালোভাবে টাকাটা খরচ করছে।সুতরাং দুর্বল কর ব্যবস্থা বাস্তবিক অর্থে এখানে সুবিধাজনক,অসুবিধাজনক নয়।”

৩০ বছরে অর্থনীতি এগিয়েছে যেভাবে:-বাংলাদেশে বসবাসের দীর্ঘ সময়টায় আমেরিকান চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন ফরেস্ট কুকসন।ছিলেন ফরেন ইনভেস্টর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বা ফিকির নেতৃত্বেও।

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন,বাংলাদেশে এই সময়ে যা ঘটতে দেখেছেন,তা তার ভাষায় ‘অসাধারণ’।

কুকসনের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অভাবনীয় এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে তিনটি ঘটনা ঘটেছে।এর প্রথমটি হল পোশাক খাতের বিকাশ।

কঠিন সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী কুকসন
“পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং খুব দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৯০ সালের আগে বাংলাদেশের রপ্তানি পরিস্থিতি ছিল খুবই দুর্বল এবং অর্থের সংস্থানের তুলনায় বেশি পণ্য আমদানির চাপ ছিল।এ কারণে দেশ বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল বৈদেশিক সাহায্যের ‍ওপর।

সরকারি খাত থেকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক বিস্তৃত হওয়াকে অগ্রগতির আরেকটি অনুঘটক হিসেবে তুলে ধরে কুকসন বলেন, “বেসরকারি ব্যাংক বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে সহায়তায় বেশি মনোযোগী,কিন্তু সরকারি ব্যাংক বেসরকারি কোম্পানির ক্ষেত্রে ততটা সহযোগী হয়নি।”

বেসরকারি ব্যাংকের বিকাশের কারণে দ্রুততার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি লেনদেনের সুযোগ তৈরি হওয়ায় ব্যবসা বৃদ্ধির কথাও তিনি বলেন।

তৃতীয় অনুঘটক হিসেবে সেনা শাসনের বিদায়ে বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ফিরে আসা এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার কথা তুলে ধরেন এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন,বেসরকারি ব্যাংকিংয়ে প্রতিযোগিতার পরিবেশ এবং বৈদেশিক মুদ্রার দুই বড় উৎসের আবিষ্কার হয়েছে এখানে, যা ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অসাধারণ কৃতিত্বের পথে চালিত করেছে।”

ভর্তুকি,আইএমএফ প্রসঙ্গ :-

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে।সে কথা তুলে ধরে কুকসন বলেন,মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য আইএমএফও সুদের হার বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়ে আসছে।তবে সুদের হার বাড়ানোর এই টোটকা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাজ করবে কি-না,সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।

তিনি বলেন,আইএমএফ সবসময় চেষ্টা করছে সরকারের ঘাটতি কমিয়ে আনার।আমার মতে,তাদের মনোযোগ অনেকটাই সরকারি ঘাটতির দিকে।তারা মনে করছে, হয়ত সঠিকভাবেই মনে করছে যে,সরকারি ঘাটতিই মূল্যস্ফীতি এবং লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি করছে।সুতরাং সরকারি ঘাটতি কমানো গুরুত্বপূর্ণ।

“যদি অনেক বেশি ভর্তুকি দিতে হয়,তাহলে সেটা বাদ দেওয়া সরকারের ঘাটতি কমানোর একটা উপায় হতে পারে।আপনি যদি এটা করতে পারেন, তাহলে সেটা প্রশাসনিকভাবে ভালো। তাতে করে আপনাকে বেশি কর আদায়ের চাপ নিতে হবে না।”

“কিন্তু যদি আপনি ভর্তুকি কমিয়ে দেন,এরপর জিনিসপত্রের দাম বাড়বে।সুতরাং মূল্যস্ফীতিও বাড়বেই।তবে তারা যুক্তি দিতে পারে যে মূল্যস্ফীতি সরকারি ভর্তুকি বজায় রাখলে যে মাত্রায় বাড়বে,এক্ষেত্রে তেমন মাত্রায় বাড়বে না।”

শেয়ারবাজার পিছিয়ে যেসব কারণে:- বিদেশিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে দুটি সমস্যা দেখার কথা বলছেন কুকসন।এর একটি হল নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে অস্থার সঙ্কট এবং অন্যটি শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস।

এই গবেষক বলেন,তারা (বিদেশিরা) বিশ্বাস করে,অনেক তালিকাভূক্ত কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন সঠিক নয়। গ্রামীণফোনের মতো কয়েকটি কোম্পানির প্রতিবেদন বিশ্বাস করলেও বাকিদের বিষয়ে তারা সন্দিহান।”

আর টানা দরপতন ঠেকাতে ‘ফ্লোর প্রাইস’ বা পতনের সীমা বেঁধে দেওয়াকে ‘খুবই জঘন্য বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করে কুকসন বলেন,তাহলে এরপর কী করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা?

“বাজার নিজে থেকে সংশোধন হয়ে যাওয়ার যে ধারণা, তা এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপের কারণে হুমকির মুখে। এ কারণে বিদেশিরা এ বাজার থেকে পালাচ্ছে।”

শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের বড় বড় উৎস বাংলাদেশে বন্ধ থাকার কথাও তুলে ধরেন ফরেস্ট কুকসন। তিনি বলেন,ক্যালিফোর্নিয়ায় সরকারি চাকুরেদের পেনশন ব্যবস্থাপনকারী কোম্পানির ৫০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল আছে,কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো সুযোগ নেই।

“বাংলাদেশে পুঁজিবাজারে অবসর ফান্ডের বিনিয়োগের সুযোগ নেই।পেনশনের নিয়ম পরিবর্তন করে যদি কোম্পানিগুলোকে এটার ব্যবস্থাপনার সুযোগ দেওয়া হয়,তাহলে বিভিন্ন দিক থেকে পেনশন তহবিল আসবে।তারা সেগুলো একত্রিত করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে।”

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ড থাকলেও এক্ষেত্রে বহু রকমের রেগুলেটরি সমস্যা থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখানে অনেক হাস্যকর বিষয় ঘটে। আর পড়তি বাজারে সফল হওয়াও বেশ কঠিন।”

জিএসপি ফিরলেও ‘বাইরে থাকবে তৈরি পোশাক’:-২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও পরের বছর রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংগঠন ‘আমেরিকান অর্গানাইজেশন অব লেবার-কংগ্রেস ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) এর আবেদনে ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়।

এর আগে পর্যন্ত ‘জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেসের (জিএসপি)’ আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি করতে পারত।

এই সুবিধা ফিরে পেতে পোশাক কারখানার কাজের পরিবেশ উন্নয়নসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি খাতের পরিবেশ উন্নয়নের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।

এরপর তৈরি পোশাক খাতসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উন্নয়ন করে সেই চিত্র জানানোর পরেও জিএসপির ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি।

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা না ফেরার প্রতিবন্ধকতা এবং এর প্রভাবের বিষয়ে অনুষ্ঠানে প্রশ্নের উত্তর দেন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সংগঠক কুকসন।

কঠিন সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী কুকসন
তিনি বলেন,জিএসপি ফিরলেও তা তৈরি পোশাক খাতে কোনো প্রভাব ফেলবে না,কারণ এ পণ্য জিএসপির তালিকায় নেই। তবে জিএসপি ফিরলে তা বাইসাইকেলে প্রভাব রাখতে পারে।

“বাইসাইকেল যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের খুব ভালো রপ্তানির পণ্য হতে পারে।জিএসপির মাধ্যমে যদি বাইসাইকেলের শুল্ক প্রত্যাহার হয়,তাহলে বাংলাদেশ আরও প্রতিযোগিতা সুবিধা পাবে।”

জিএসপি না ফেরার পেছনে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকানদের মনোভাবকে কারণ হিসাবে বর্ণনা করেন কুকসন।

“তাদের ধারণা হল,বাংলাদেশে সরকার ট্রেড ইউনিয়নকে স্বাধীনভাবে নিবন্ধিত হতে দেয় না।অবশ্য বাংলাদেশ সরকার বলে থাকে,তারা দেয়।

“দর কষাকষির সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শগত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।এবং এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ইস্যু এই কারণে যে,যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের বড় সমর্থক হচ্ছে।”

তিনি বলেন,নতুন ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা ও সামষ্টিক দরকষাকষির বিষয়ে অগ্রগতি নিয়ে আপনাকে আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।তবে এক্ষেত্রে সাফল্য কতটা আসবে, তার নিশ্চয়তা নেই।”

আরও খবর

Sponsered content