জাতীয়

এনএলডিসি তাদের কার্যালয়ে বসেই সব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্কাডার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না

  প্রতিনিধি ৭ অক্টোবর ২০২২ , ১:৪৫:১১ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ৪ অক্টোবর দেশের পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়ে এই বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। এতে সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে গিয়েছিল। আর আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সির কারণেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আনস্টেবল হয়েই পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ট্রিপ করে। এতে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়।

প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের বিভ্রাট এড়াতে হলে অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে আছে। আরও আধুনিক ব্যবস্থা করতে হবে বলেও তিনি জানান।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত ৪ অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতি ছিল এবং পশ্চিমাঞ্চলে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল। এ অবস্থায় পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। ঘটনার সময় আশুগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের ২৩০ কেভির দুটি সার্কিট এবং ঘোড়াশালের দুটি সার্কিট ট্রিপ করায় পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে গত ৪ অক্টোবরের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান, পিডিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন।

উৎপাদন ও সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন একসঙ্গে হচ্ছে না। এর ফলে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে যাওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর বিদ্যুৎ গ্রিড বিপর্যয়ের বড় ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি করবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সঞ্চালন জটিলতার কারণে মূলত গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর সেটি গ্রিড সাবস্টেশনে পৌঁছানো এবং সঞ্চালনের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার সময় এই সমস্যা সৃষ্টি হয়। উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলেই বিপর্যয় ঘটে। এ ক্ষেত্রে সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে যায় এবং আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সির কারণেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আনস্টেবল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় স্থিতিশীল গ্রিডের জন্য উৎপাদন এবং সঞ্চালন ব্যবস্থায় দ্রুত অটোমেশন চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে বর্তমানে দেশে উৎপাদন এবং সঞ্চালন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে টেলিফোনে। এটি করছে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার বা এনএলডিসি। সংস্থাটি বিদ্যুতের চাহিদা দেখে কেন্দ্র চালানোর নির্দেশ দেয়। আবার চাহিদা কমে গেলে কেন্দ্র বন্ধ করারও নির্দেশ দেয়।এমনকি কোন কেন্দ্র কত বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তাও ঠিক করে দেয় এনএলডিসি।

উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশে এই কাজটি স্বয়ংক্রিয় পন্থায় অর্থাৎ অটোমেশনের মাধ্যমে করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনএলডিসি তাদের কার্যালয়ে বসেই সব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্কাডার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারা টেলিফোনে কেন্দ্রগুলোকে কত লোডে চালাতে হবে তা শুধু জানিয়ে দেয়। আবার কোনো কেন্দ্র বন্ধ করতে হলেও সেই টেলিফোনের মাধ্যমে করতে হয়। এতে অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। যার কারণে এ ধরনের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে।

ফলে পূর্বাঞ্চলের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে যায় এবং আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সির কারণেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আনস্টেবল হয়েই পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ট্রিপ করে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, এ অবস্থা নিরসনে ‘যত দ্রুত আমরা অটোমেশনে যাব, তত দ্রুত সমস্যা কমে আসবে। আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলাম। করোনার কারণে দুই বছর আমাদের অনেক কাজ পিছিয়ে গেছে। তিনি বলেন, পিজিসিবি অনেক কাজে পিছিয়ে আছে। বিতরণে আমরা যতটা এগিয়েছি, সঞ্চালনে সেই পরিমাণ এগোতে পারিনি। আরও আধুনিকভাবে আমাদের কাজ করতে হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে সঞ্চালন ও বিতরণ এই তিন জায়গাতেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মতে, আগামীতে দেশে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে। পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ি, রূপপুরের সব ইউনিট ২০২৪ এবং ২০২৫-এর মধ্যে উৎপাদনে আসতে শুরু করবে। ভারত থেকেও আসবে বিদ্যুৎ। এ অবস্থায় গ্রিড স্থিতিশীল করতে না পারলে আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, গ্রিড বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের ভারসাম্য না থাকা। অর্থাৎ কখনো চাহিদা রয়েছে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের, কিন্তু উৎপাদন হঠাৎ ১২ হাজার মেগাওয়াটে নেমে গেল, অথবা ১৩ হাজারে উঠে গেল। এরকম হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের তরঙ্গে বিঘ্ন ঘটে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, কখনো যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে তাহলে তা কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে সমাধান করার নিয়ম। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে যদি হুট করে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায় তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাৎক্ষণিক সরবরাহ বন্ধ করলে আর গ্রিড বিপর্যয় ঘটে না। এ ধরনের সংকট সমাধানে সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থায় ক্যাপাসিটর ব্যাংক বসানো থাকে। তবে মাঝে মাঝে সেগুলোও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে না।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গ্রিড সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে গ্রিডের কোনো একটা লাইন যদি আকস্মিক বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেই পরিমাণ সরবরাহ যেন সঙ্গে সঙ্গে আমরা বৃদ্ধি করতে পারি সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে। অন্য দিকে আমাদের যেখানে যেখানে সাবস্টেশন দরকার সেখানে সেগুলো নির্মাণ করা। গ্রিডের প্রয়োজনীয় সবখানে ক্যাপাসিটর ব্যাংক বসানো। তিনি বলেন, আমরা যত দ্রুত স্মার্ট গ্রিডের দিকে যাব, ততই এই সমস্যার সমাধান হবে। একটি মার্কিন কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগ করে কিছু কাজও এগিয়ে রেখেছি। স্মার্ট কাজের অংশ হিসাবে বিতরণ লাইন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট হয়েছে। কিন্তু সঞ্চালনের কাজে আরও সময় লাগবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের গ্রিড সম্পূর্ণ অটোমেটেড না। অটোমেটেড হলে মানুষের ওপর পুরো নির্ভরশীল হতে হতো না। মেশিনই বলে দিত ত্রুটি কোথায়। এজন্য আর তদন্ত কমিটি করে ত্রুটি খোঁজার প্রয়োজন হতো না। অন্য দিকে, এখন অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করে লোড কমানো-বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখন মেশিনেই সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।

তিনি বলেন, হাইলোডে আমরা অপারেট করছি। আর লো লোডে সাপ্লাই করছি। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় গ্রিড ফেলের আশঙ্কা থেকে যায়। সামনে আরও বেশ কিছু বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হচ্ছে। তাদের এসব বড় বিদ্যুতের লোড যখন সঞ্চালন লাইন দিয়ে প্রবাহিত হবে, হুট করে এত লোড অফ হয়ে গেলে গ্রিডে বিপর্যয় ঘটতে পারে।

এদিকে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ২০১৪ সালের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘সেদিনের ঘটনা আর আজকের ঘটনা একেবারেই আলাদা। সেই সময়ের তুলনায় আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছি। এবার যত দ্রুত আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছিলাম, গতবার সেটা হয়নি। এবার সাত ঘণ্টার মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। ঢাকায় আমরা দেরি করেছি, কারণ ঢাকার চাহিদা বেশি, তাই আবার ট্রিপ করার ঝুঁকি নেইনি। আস্তে আস্তে ঢাকায় সরবরাহ শুরু করা হয়।’

৪ অক্টোবর গ্রিড বিপর্যয় নিয়ে রাজনীতিবিদদের সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা অনেক কথাই বলছেন, কেউ কেউ তো টেকনিক্যাল বিষয় নিয়েও কথা বলছেন। মজার বিষয় হলো, তাদের সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। তারা এক মেগাওয়াটও যোগ করতে পারেনি। অথচ তারা সমালোচনা করে যাচ্ছেন।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমরা প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে জানালাম।’ পুরো ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পেতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে বলে তিনি জানান।

তিনি আরও বলেন, ৪ অক্টোবর গ্রিড ফেল করার পর রাত ৯টার মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। প্রথমে রাত ৯টা ৮ হাজার ৪৩১ মেগাওয়াট, এরপর আস্তে আস্তে বেড়ে তা রাত ১২টায় ১০ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় সাত ঘণ্টার মধ্যে পূর্বাঞ্চলের পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পেরেছি আমরা। অনাকাক্সিক্ষত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ উদঘাটনে পিজিসিবির পক্ষ থেকে একটি সাত সদস্যের কমিট গঠন করা হয়েছে।

কমিটিতে বুয়েট ছাড়াও অনেক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের বাইরের লোক নিয়ে আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুটি কমিটি এখন তদন্তের কাজ করছে। কমিটির সদস্যরা ৫ অক্টোবর ঘোড়াশাল গ্রিড উপকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তারা জানান, গ্রিড বিপর্যয় হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কোনো ফিজিক্যাল ড্যামেজ পরিলক্ষিত হয়নি। সেজন্য তদন্ত কমিটি গ্রিডের নানা বিষয়ে তথ্য পর্যালোচনা করতে কিছুটা সময় চেয়েছে।

আরও খবর

Sponsered content