জাতীয়

আমি আওয়ামী লীগের অনেক কিছুই পছন্দ করি না

  প্রতিনিধি ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৯:০৪:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বাংলাদেশের অনেক সাবেক সেনা কর্মকর্তা রয়েছে যারা এখন বিদেশে স্থায়ী ভাবে বিশ্বাস করছেন। তাদের মধ্যে বেশ সুপরিচিত একজন হচ্ছেন সাবেক কর্নেল লে: কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান।সম্প্রতি তাকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে দেশের ডিজিএফআই। এ নিয়ে এবার তিনি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। সেখানে তিনি এই ভিডিও নিয়ে জানিয়েছেন অনেক কথা। পাঠকদের উদ্দেশে তার সেই লেখনী তুলে ধরা হলো হুবহু:-

‘কে এই লে: কর্নেল মোস্তাফিজ’ শীর্ষক ভিডিওটি দেখে আমি ও আমার পরিবার রীতিমত হতাশ!

ফেসবুকে লেখালেখির শুরুতেই আমি আমার মা, বোন, স্ত্রী-সন্তানদের বলে রেখেছিলাম যে সময় হলে এই আওয়ামীলীগ সরকার মিডিয়ায় দেখবে আমার এক বা একাধিক গার্লফ্রেন্ড আছে অথবা আমার মরহুম পিতা এবং শ্বশুর উভয়েই যেহেতু সরকারী চাকুরীজীবি ছিলেন তাই তাদের নামে দুর্নীতির অপবাদ আসবে।

সে যাই হোক, ডিজিএফআই মনে হয় একটু বেশীই হুটোপাটি করে ভিডিওটি বানিয়েছে। তারা আমার ফাইল তন্নতন্ন করে খুঁজে যখন দেখলো একটাও লাল কালি নেই, চাকুরীর শেষদিকে এএসইউ (আর্মি সিকিউরিটি ইউনিট)তে চাকুরী করেছে (যেখানে চাকুরী করতে হলে প্রথম শ্রেণীর নিরাপত্তা ছাড়পত্রের দরকার হয়) এবং এই মোস্তাফিজ ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক পেয়েছে যার ছবি দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে লিড নিউজ হিসাবে ছাপা হয়েছে- তাই শেষ পর্যন্ত এই অফিসার শুধুমাত্র চতুর এবং সুযোগসন্ধানী বলেই ভিড্যু শেষ করতে হলো! বলিহারি যাই ডিজেএফআই এর ক্রিয়েটিভ পেইড পান্ডাদের! আর কিছু না হোক, ২৮ বছরের সুদীর্ঘ সামরিক জীবনে দুই/চারটা বিবাহ কিংবা নারীঘটিত কেলেঙ্কারি কিংবা নিদেনপক্ষে পারিবারিক কলহের রিপোর্ট যদি থাকতো তবে তাতে রং চড়ানো যেত!

আজ হঠাৎ মনে হলো, আমার চাকুরী জীবনে একটা উশৃংখল আচরণের রিপোর্ট তো আছেই সেটা বলে তো একটু রং চড়ানো যেত! ডিজিএফআই কেন উল্লেখ করলো না সেটা? ডিজিএফআই এর অসমাপ্ত কাজটা তবে আমিই করে দিই!

আমি এসিসি-৬ (আর্মি কমান্ডো কোর্স) চলাকালীন আমার কোর্সমেট কাম তৎকালীন রুমমেট লে: জিয়াউল আহসান (বর্তমানে মেজর জেনারেল) সহ এক বৃহষ্পতিবার আমার মোটর সাইকেলে চড়ে সিলেট শহরে গিয়েছি। অতি কষ্টকর প্রশিক্ষণের পর একটু ভালমন্দ খাওয়া দাওয়ার উদ্দেশ্য আমাদের। প্রথমে আমরা দুইজন লতিফ সেন্টারে যাই একটু ঘুরাঘুরি করতে। ঘুরাঘুরি শেষে জিয়া আমাকে বলল, চল রাস্তার উল্টাদিকের কুরিয়ার সার্ভিসটাতে যাই। আমি ভাবলাম, কোন কাজ আছে হয়তো অথবা ভাবী (জিয়ার তৎকালীন গার্লফেন্ড) নিশ্চয়ই কিছু পাঠিয়েছে কুরিয়ারে।

ভাবলাম কী আর হলো কী! আমরা কুরিয়ার সার্ভিসের দোকানে ঢোকামাত্র জিয়া দোকানের এক কর্মচারীর কলার ধরে ধুমাধুম ঘুষি মারতে মারতে বলতে থাকলো, ‘তোরা আমার টাকা মাইরা দিছস ক্যা’? ক্যান মারছস ক’! জিয়া বারংবার একই কথা বলছে আর কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেটানো হাতে লাগাতার ঘুষি দিয়েই যাচ্ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি থ! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমি কী করবো আর কী বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। এখানে আসার আগে জিয়া আমাকে কিছু বলে নিয়ে আসেনি। আমি কিছু না বুঝে জিয়াকে থামানোর চিন্তা করছিলাম। এর মধ্যেই দেখি দোকানে বসে থাকা অন্য একজন লোক তার পাশে রাখা কাঠের কিছু লম্বা স্টিক নিয়ে জিয়ার দিকে তেড়ে আসছে। এবারে আমার এ্যান্টেনা সটান দাঁড়িয়ে গেল। কী! আমার বন্ধুকে মারতে আসছে? এত্ত বড় বুকের পাটা?

আই মাস্ট জয়েন দ্যা ফাইট নাও!

পরবর্তী কয়েক মিনিটে দোকানে শুনশান নীরবতা। একজনের ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে, আর একজন লাঠির বাড়ি খেয়ে কোনায় পরে কাতরাচ্ছে। এরই মধ্যে দেখলাম অন্যান্য দোকানের লোকজন বের হতে শুরু করেছে। সম্মিলিত গলার আওয়াজ বাড়ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি জিয়ার হাত ধরে টান দিয়ে বের হয়ে এলাম দোকান থেকে। মোটর সাইকেলে চেপে সোজা একটানে অনুরাগ হোটেলের সামনে চাইনিজ রেস্টুরান্টে এলাম।

কী হয়ে গেল এইটা? আমি রেস্টুরান্টে এসেই প্রশ্ন করি,

: জিয়া, এইটা তুই কী করলি দোস্ত? কেন মাথা গরম করলি ক!

: দোস্ত, জলিরে এই কুরিয়ার সার্ভিসে ১৫০০ টাকা খামের ভিতর পাঠাইছিলাম। শালারা আমার কষ্টের টাকা মাইরা দিসে! তোর ভাবী টাকা পায় নাই!

: জিয়া তুই জানস আমি সিলেটে লেখাপড়া করছি। ক্যাডেট কলেজে ঢোকার আগে এখানের এইডেড স্কুলে পড়ছি। এই ধরনের সিচুয়েশন ম্যানেজ করার জন্য আমার অনেক লোকাল ফ্রেন্ড আছে। আমাকে কইতি আগে! এই ট্রেডমার্ক চুল নিয়ে যা ঘটাইলাম দুইজনে, আজ দেখ ক্যান্টনমেন্টে গেলে কী হয়!

এরপর পরিশ্রান্ত দুই বন্ধু মিলে বর্তমান পরিস্হিতি নিয়ে হাসি ঠাট্টার বিশ্লষন করে চাইনিজ খেলাম। কতদিন এমন মজার খানা খাইনি! খাওয়াদাওয়া শেষ করে সেনানিবাসে ফিরে দেখি একজন প্রশিক্ষক আমাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন স্যার আপনারা দুইজন এখনই ২৬ আইটেম সহ মানিক স্যারের অফিসে যান। ২৬ আইটেম মানে পুরো ব্যাটেল গিয়ার আর আমাদের ওআইসি মেজর মানিক স্যারের অফিসে যেতে হবে।

জিয়া আর আমি দুইজনেই বুঝে গেলাম বিশাল ধরা খাইসি!

দুরুদুরু বক্ষে মানিক স্যারের রুমের সামনে গেলাম। কাচুমাচু দুই বন্ধুকে স্যার আর ভিতরে ডাকেন না। তিনি কার সাথে যেন কথা বলছেন। পরে বুঝলাম সিলেটের ডিজিএফআই এর ডেট কমান্ডারের সাথে কথা বলছেন স্যার। এরপর আবার প্রধান প্রশিক্ষক লে: কর্নেল জহুর স্যারের সাথে কথা বলছেন তিনি। অনেকক্ষণ পর মানিক স্যার অতি গম্ভীর কন্ঠে যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে, তোমাদের দুইজনকে দুইটা মেজর মাইনাস (পানিশমেন্ট) দেয়া হল আর সিলেট শহর অনিদৃস্টকালের জন্য আউট অব বাউন্ড!

পরেরদিন জিয়া সিলেটের ৪/৫ টা স্হানীয় পত্রিকা নিয়ে এলো যেখানে পুরো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা সহ আমার মটরসাইকেলের নাম্বার প্লেট পর্যন্ত উল্লেখ করা। ততোক্ষণে বুঝে গেছি চিনা খাবার হজম হয়ে গেছে কিন্তু এই ঘটনা হজম করা যাবেনা কিছুতেই!

খুশীর কথা হলো যে আমাদের এই অপরাধী অপরাধী ভাবটা কয়েকদিন পরই চলে গেল যখন শুনতে পেলাম অন্য একটি প্রশিক্ষণ পরিদর্শনের সময় প্রধান প্রশিক্ষক লে: কর্নেল জহুর বলেছেন, অই দুই দুষ্টকে আমি বাঁচিয়েছি কারণ ওরা মাইর দিয়ে এসেছে খেয়ে আসেনি। কমান্ডো হয়ে মার খেয়ে আসলে তাকে কোর্স থেকে বের করে দিতাম।

আমি নিশ্চিত এই ঘটনায় শুধু আমি জড়িত থাকলে বা এটার জন্য নথিবদ্ধ কোন পানিশমেন্ট থাকলে ডিজিএফআই এর ভিডিওতে আমাকে সেনাবাহিনীর চাকুরীর শুরুতেই উশৃংখল আচরণের জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত শুধু নয় বরং এটার উপর আরও রং চড়ানো যেত। কিন্তু এই ঘটনা উল্লেখ করলে সদ্য প্রমোশন প্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এর বিরুদ্ধেও যে চলে যায়! এক যাত্রায় দুই ফলের কথা আমাদের সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ডিজিএফআই ক্যাম্নে কয়!

অনেকে মনে করতে পারেন জিয়া আমার এত কাছের বন্ধু তাই তার বিরুদ্ধে কিছু লিখা অশোভনীয়। সাধারণত তা’ই হবার কথা তবে এই ফ্রেন্ডশীপ কোড আমি ভাঙি নাই। আমাদের দু’জনের বন্ধুত্বের হিসেব অনেক লম্বা। আমি যেমন প্রয়োজনে তার পাশে দাঁড়িয়েছি তেমনি সে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে বহুবার। আমি এএসইউ ঢাকা ডেটের অধিনায়ক থাকাকালীন জিয়া ছিল RAB এর গোয়েন্দা প্রধান। সে আমাকে প্রটোকল ভেঙে বহুবার আমার নিজের তদন্ত বিষয়ক ফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে দিয়েছে। সেই বন্ধু জিয়া প্রথমবার আমার সাথে ফ্রেন্ডশীপ কোড ভংগ করে ২০১১ সালে, এর পর আরও দুইবার। আমার বন্ধু মেজর বোরহানের সাথে একজন অফিসারের বিষয়ে আলাপ করার সময় আমি কথা প্রসংগে তাকে বলেছিলাম, ‘আমি আওয়ামী লীগের অনেক কিছুই পছন্দ করি না’। আমার বন্ধু মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান আমার আর বোরহানের ফোনকল রেকর্ড করে অতি দ্রুত জেনারেল তারেক সিদ্দিকীর কাছে নিয়ে যায়।

“Some people are willing to betray years of friendship just to get a little bit of the spotlight.” — Lauren কনরাড

সত্য সমাগত মিথ্যা বিতাড়িত

প্রসঙ্গত, সাবেক কর্নেল লে: কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান স্থায়ী ভাবে থাকছেন বিদেশে। তবে দেশের সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তিনি ফেইসবুক এ লেখালেখি করে থাকেন তার লেখার জনপ্রয়িতাও বেশ তুঙ্গে।

আরও খবর

Sponsered content