রাজনীতি

অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে-বিএনপি

  প্রতিনিধি ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ , ১:২৫:৪৯ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জনসহ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি।

গতকাল বুধবার ঘোষিত কর্মসূচিতে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন,ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া,নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনী দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকা, সেবামূলক কর,খাজনাসহ বিভিন্ন প্রদেয় না দেওয়া,ব্যাংকে অর্থ আমানত না রাখা এবং আদালতে হাজিরা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।একই সঙ্গে দাবির পক্ষে জনমত গঠনে গণসংযোগ কর্মসূচিও ঘোষণা করছে তারা।

আজ বৃহস্পতিবার থেকে টানা তিন দিন লিফলেট বিতরণ করবে বিএনপি।একই সঙ্গে আগামী রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি।নির্বাচনের আগে ‘গণকারফিউ’র মতো কর্মসূচি দিতে পারে দলটি।

অবশ্য অসহযোগ আন্দোলন বাস্তবায়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করাই বড় চ্যালেঞ্জ;বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।তারা বলছেন,একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল নেতৃত্ব ও জাতীয় ঐক্যের কারণে।এখন জাতি বিভক্ত।এ পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করে,কীভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারবে– সেটাই দেখার বিষয়।অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বিষয়টিও স্মরণ করেন তারা।

বুধবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী পৃথকভাবে অসহযোগসহ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

এর আগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশ ও জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন।তার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরে সংবাদ সম্মেলনে তার বরাত দিয়ে রুহুল কবির রিজভী অসহযোগসহ আন্দোলনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন।পরে পৃথক আরেক সংবাদ সম্মেলনে তিনি লিফলেট বিতরণ ও অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বিএনপির সমমনা দল ও জোটগুলো একই কর্মসূচি পালন করবে বলে জানান রিজভী আহমেদ।অবশ্য গত রাতে বিএনপির যুগপৎ কর্মসূচির বাইরে থাকা জামায়াতে ইসলামীও একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

প্রায় ২৭ বছর পর দেশে অসহযোগের মতো কর্মসূচি নিয়ে দলটির নেতাকর্মীর মধ্যে নানা আলোচনা চলছে।এই আন্দোলনের ধরন কী হবে,তাদের কাজ কী হবে– সেটা নিয়েও অনেকে আছেন ধোঁয়াশায়।এ কর্মসূচি ঘোষণার আগে সমমনা জোট ও দলের সঙ্গেও কোনো আলোচনা হয়নি বলে অনেকে জানান।তবে কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই ১২ দলীয় জোটসহ বেশ কয়েকটি দল অসহযোগ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছেন।তারাও একই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।তবে গণতন্ত্রমঞ্চসহ বেশ কয়েকটি দল অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা না করে লিফলেট বিতরণ ও অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে ১৯৭১ ও ১৯৯৬ সালে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল।যে দুটি আন্দোলনেরই নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ।এই আন্দোলনকে অহিংস বলা হলেও কোনো আমলেই সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।এ ছাড়া ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এক আন্দোলনের ডাক দেয়,ইতিহাসে যা অসহযোগ আন্দোলন নামে পরিচিত। অহিংস পদ্ধতিতে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করে ভারতের ব্রিটিশ শাসনকে ব্যর্থ করে দেওয়াই ছিল এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।সব অফিস ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি স্কুল,পুলিশ বিভাগ,সেনাবাহিনী থেকে সরকারি চাকরি ত্যাগ করেন।আইনজীবীরা সরকারি আদালত বর্জন করেন। এ ছাড়া গণপরিবহন,ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রী,বিশেষ করে কাপড় বর্জন করা হয়।

তবে সেই আন্দোলনও একসময়ে সহিংসতায় রূপ নেয়।যার কারণে আন্দোলন স্থগিত করতে বাধ্য হন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলমান থাকে। ১৯৯৬ সালে ‘একতরফা’ নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আওয়ামী লীগ হরতাল-অবরোধের মতো রাস্তার কর্মসূচির পাশে টানা ১০৮ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল সমকালকে বলেন,একটা কর্মসূচি ডাক দিলেই তো হবে না।সেটাকে বাস্তবায়নও করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জনগণ যদি ট্যাক্স-খাজনা বন্ধ না করে, তারা যদি বিচারালয়ে যায়,তাহলে তো আর সেটা অসহযোগ হবে না। আর দেশের যে অবস্থা তাতে জনগণ যদি ওই আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হয় তাহলে সফল হবে না।দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলন কতটুকু বাস্তবায়ন হয়– তা দেখার বিষয়।

বিএনপি নেতারা জানান,প্রায় তিন দশকের মাথায় আবারও দেশে প্রায় একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।এবারও আওয়ামী লীগ একটি একতরফা নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তারা একই ধরনের নির্বাচন আয়োজন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে।এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিরোধী দলবিহীন ‘একতরফা’ নির্বাচন করতে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসনকে কাজে লাগাচ্ছে।অন্যদিকে বিএনপিসহ দেশের ৬৩টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রতিহত করতে এবং নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলন করছে।

বিরোধী দলের নেতারা আরও জানান,গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেওয়ার পর বিরোধী দলের ওপর ক্রাকডাউন চলছে,সাঁড়াশি অভিযান চলছে। প্রায় ২৩ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।সরকারের এমন দমন-নির্যাতনের প্রতিবাদে আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তারা রাজপথের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এখন আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে ‘অলআউট’ মিশনে রয়েছেন তারা।অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিও পালন করবেন তারা। ভোটের আগের কয়েক দিন ‘গণকারফিউ’র মতো কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে বলে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান।

আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন,অহিংস আন্দোলনের এই ধাপে সরকারের ওপর নীরব প্রতিবাদ হিসেবে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।এতে দেশে আন্দোলনের নতুন মাত্রা আসবে।এতদিন হরতাল-অবরোধে সহিংসতার জন্য এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দায় দিয়ে আসছিল।সেখানে এই আন্দোলনে কোন পক্ষ সহিংসতার সুযোগ পাবে না।অন্যদিকে জনগণও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে বলে তিনি মনে করছেন।

সংবাদ সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে রুহুল কবির রিজভী জানান,প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আজ (বুধবার) থেকে সরকারকে সব ধরনের অসহযোগিতা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।এটা শুরু করার বিকল্প নেই।

এ মুহূর্ত থেকে এই অবৈধ সরকারকে সহযোগিতা না করার জন্য প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আপনারা ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচন বর্জন করুন।ডামি নির্বাচনের নামে ৭ জানুয়ারির বানর খেলার আসরে অংশ নেবেন না।আপনারা কেউ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।এটি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার।নির্বাচন কমিশন ৭ জানুয়ারি কাকে এমপি ঘোষণা করবে, সেই তালিকা তৈরি হয়ে গেছে।সুতরাং ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালনে বিরত থাকুন।

ভোট বর্জন ছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষিত অন্যান্য কর্মসূচির কথা তুলে ধরে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকারের সব ধরনের ট্যাক্স-খজনা-ইউটিলিটি বিলসহ অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত রাখুন।ব্যাংকগুলো এই অবৈধ সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম।সুতরাং ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কিনা সেটি ভাবুন।

মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় লাখ লাখ নেতাকর্মীর আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন,আদালতের সুবিচার করার স্বাধীনতা ফ্যাসিবাদী সরকার কেড়ে নিয়েছে।এই অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আপামর জনগণের স্বার্থবিরোধী এই সরকারকে প্রতিহত করে শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠার এখনই চূড়ান্ত সময়।

তিনি বলেন,চলমান এ আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতায় পৌঁছাতে দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গণতন্ত্রকামী মানুষকে বর্তমান অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতা শুরু করুন,অপরকে অসহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করুন।

বর্তমান সরকার সাংবিধানিকভাবে ‘অবৈধ’ উল্লেখ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন,এই অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতা করতে গিয়ে প্রশাসন কিংবা দেশপ্রেমিক জনগণ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন,পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার অবশ্যই তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে।মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের ত্যাগের প্রতি সুবিচার করবে।গণতন্ত্র,মানবাধিকার এবং লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষে যারাই হতাহত হয়েছেন,ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক সরকার তাদের অবদান দলীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দেবে।

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন,সংসদ বাতিলের ‘একদফা’ দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দল ও জোটগুলো।গত ২৮ অক্টোবর পর ‘একতরফা’ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর তারা ৪ দফায় পাঁচ দিন হরতাল ও ১১ দফায় ২২ দিন অবরোধ কর্মসূচি করে।এরপর অসহযোগ আন্দোলনের এই কর্মসূচি দিল বিএনপি।

আরও খবর

Sponsered content