প্রতিনিধি ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১০:৪৯:৪৩ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।বরিশাল-৪(হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথকে আওয়ামী লীগের সকল পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার নেপথ্যে বেরিয়ে আসছে নানা কারণ।
সোমবার আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাকে সব ধরনের দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার তথ্য নিশ্চিত করা হয়। পঙ্কজকে অব্যাহতি দেয়ায় তার কাছে নির্যাতনের শিকার হওয়া নেতাকর্মীরা সোমবার রাতে মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলায় মিষ্টি বিতরণ করেছেন।
জানা যায়, বরিশাল ৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপের একটি পক্ষকে শেল্টার দেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, এই পক্ষে রয়েছেন বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মইদুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট মনসুর আহমেদ এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান। অপর পক্ষকে শেল্টার দেন এমপি পঙ্কজ দেবনাথ। এই দুই পক্ষের বিবাদে গত ১০ বছরে ৯ জনের বেশি নেতাকর্মী খুন হয়েছেন হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়। আহত হয়েছেন অনেকে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে হারানো, বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দেয়া, জেলা আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতাদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, নিজ দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হামলা ও রামদা দিয়ে কোপানোর হুমকিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে। হুমকিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের জেরে দলের সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তাকে। গত ১০ বছরে ওই এলাকায় নিজ দলের গ্রুপিংয়ের দ্বন্দ্বে ৯ জনের প্রাণহানির নেপথ্যেও পঙ্কজ দেবনাথের প্রশ্রয় ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের জাতীয় ও স্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে পঙ্কজ দেবনাথের বিতর্কিত মন্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার দাপটে কোণঠাসা স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ।
এমপি পঙ্কজের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতরে। তিন বছর আগে ক্যাসিনোকাণ্ডের অভিযোগে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকেও অব্যাহতি পান পঙ্কজ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলায় দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন এমপি পঙ্কজ দেবনাথ। মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মনসুর আহমেদ। তিনি সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। কিন্তু পঙ্কজ সমর্থন দেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাহফুজুল ইসলাম লিটনকে। নিজ অনুসারীকে জেতাতে পঙ্কজ সবধরনের চেষ্টা করেছিলেন।
তার ম্যাকানিজমে ভরাডুবি হয় নৌকার। একই পরিস্থিতি হিজলা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো: টিপু সুলতান। সেখানে পঙ্কজ সমর্থন দেন বিদ্রোহী প্রার্থী বেলায়েত ঢালীকে। ফলে এখানেও নৌকার ভরাডুবি হয়। একইভাবে ইউপি নির্বাচনেও ২১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টিতে পঙ্কজ নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে দেন। এসব ইউনিয়ন হলো- গুয়াবাড়িয়া, হরিনাথপুর, মেমানিয়া, আন্দার মানিক, লতা ও জয়নগর।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এমপি পঙ্কজের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যাতে শোনা যায়, তিনি সাবেক সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে নিয়েও কটাক্ষ করেছিলেন। যিনি আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের একজন। ওই ভিডিওতে পঙ্কজকে বলতে শোনা যায়, গাফফার চৌধুরী আমার বিরুদ্ধে যুগান্তর পত্রিকায় লিখেন। ওনার মায়ের নাম কী, বাবার নাম কী, আমি মুখ দিয়ে বলতে চাই না।
আরেকটি সূত্র জানায়, পঙ্কজ দেবনাথ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদকে নিয়েও কটাক্ষ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আকতারের বাবা তিনি। এ নিয়েও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশও করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে পঙ্কজের অনুসারীরা নানা বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব বক্তব্য আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকেও বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
এদিকে বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তাকে (পঙ্কজ নাথ) আওয়ামী লীগের বরিশাল জেলা শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদসহ অন্য পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে কার্যনির্বাহী সংসদ। এ বিষয়ে তার লিখিত জবাব ১৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় দফতর বিভাগে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
এমপি পঙ্কজ দেবনাথ অব্যাহতির চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, এ নিয়ে এই মুহূর্তে বেশি কিছু বলার নেই। চিঠির অনুলিপি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো: ইউনুসের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
তালুকদার মো: ইউনুস জানান, এমপি পঙ্কজ দেবনাথ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি নিজ রাজত্ব কায়েম করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দল বাজিয়ে রাখতেন। এ সকল বিষয় অবহিত হয়ে কেন্দ্র এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।