প্রতিনিধি ২৮ আগস্ট ২০২২ , ৪:৪৮:২৮ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:-খুনের অভিযোগে জেলে যাওয়ার সময় ইসমাইল হোসেন বাবু ২৫ বছরের এক টগবগে তরুণ। ২০০৮ সালের ১৩ মার্চ ফাঁসির রায়ের পর তার ঠাঁই হয় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে। ২০০৯ সালের ১৮ জুন সেখান থেকে মা রুমালী বেগমের কাছে পোস্টকার্ডে একটি চিঠি লেখেন ইসমাইল।
কারা কর্তৃপক্ষের সেন্সর করা সেই চিঠির একটি অংশে ছিল ‘মা, আমি ভালো আছি।
আমার জন্য কোনো চিন্তা করবে না। নামাজ শেষে আমার জন্য দোয়া করিও যেন তোমার কাছে ফিরে যেতে পারি। ’
প্রায় ১৪ বছর পর চূড়ান্ত বিচারে খালাস পেয়ে ছেলে মায়ের কাছে ফিরে এসেছে।
কিন্তু এ সময়ে তিনি হারিয়েছেন অনেক কিছু। চিঠিতে মাকে সান্তনা দিতেই ‘আমি ভালো আছি’ এ কথা লিখেছিলেন, তা-ও জানালেন তিনি। আঞ্চলিক ভাষায় ইসমাইল বলেন, ‘কনডেম সেল মানে মরার আগে মরে যাওয়া। মিনিটে-সেকেন্ডে মৃত্যুর যন্ত্রণা নিয়ে কে আর ভালো থাকতে পারে বলেন?’
একই মামলায় একই দিনে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত মো. সোনারদি ওরফে সোনারুদ্দিকেও (তখন তার বয়স ৩৫ বছর) পাঠানো হয়েছিল একই কারাগারের কনডেম সেলে। তিনিও এখন মুক্ত। ২০০৯ সালের ২০ ডিসেম্বর সোনারুদ্দির ছোট মেয়ে মিনু আক্তার একটি চিঠি পাঠায় বাবাকে।
মেয়ের একটি বিশেষ অনুরোধ ছিল এ রকম, ‘আপনার কাছে অন্য সব লোক যারা আছে তাদের কাছে একটু করে পড়া শিখবেন, এটা আমি চাই। ’ সোনারুদ্দি বলেন, ‘মেয়ের কথা রেখেছি। একটু একটু পড়তে পারি। জীবন থেকেও অনেক শিক্ষা নিয়েছি। সব হারিয়েছি। ভবিষ্যতে কী হবে, জানা নেই।
রাজশাহী-গোদাগাড়ী সড়কের ডাইনপাড়া মোড়ের উত্তর পাশ দিয়ে কয়েক কিলোমিটার পার হয়ে জৈটাবটতলা মোড়। সেখান থেকে বাম দিকে একটি অপ্রশস্ত সড়ক চলে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের দিকে। গোদাগাড়ীর মোহনপুর ইউনিয়নের এ সড়কের মধ্যবর্তী এলাকায় ধোয়াপাড়া-যৌবনলাইন গ্রাম। সড়কের ডানপাশে রেলওয়ে থেকে লিজ নেওয়া জমিতে ইসমাইলদের মাটির বসতঘর। একটু দূরে মো. সোনারদি ওরফে সোনারুদ্দিদের ঘর।
গত ২৩ জুন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে খালাস পাওয়ার কিছুদিন পর মুক্তি পান ইসমাইল। সোনারুদ্দি মুক্তি পান ২ আগস্ট। জেলে যাওয়ার আগে এলাকায় কোলস্টোরেজের শ্রমিক ছিলেন ইসমাইল ও সোনারুদ্দি। মামলা চালাতে গিয়ে দুই পরিবারই এখন নিঃস্ব। এখন তাদের কর্মক্ষমতা নেই। শারীরিক অবস্থা করুণ। দশ কদম হাঁটলেই হাঁপিয়ে যান। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা আর আর্থিক অনটন তাদের ঘিরে ধরেছে।
সম্প্র্রতি তাদের সঙ্গে কথা হয় ইসমাইলদের বাড়িতে। কনডেম সেলের দুঃসহ দিনগুলো এখনো তাড়া করে তাদের। নির্জন কুঠুরিতে কাটিয়ে মানসিক ট্রমায় ভুগছেন তারা। দুজনই কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ। কখনো নীরব থাকেন, কখনো হড়বড় করে কথা বলেন। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়েছে। দীর্ঘ দিন চোখে আলোর ছোঁয়া লাগেনি। দৃষ্টিশক্তি ক্রমেই কমছে।
১৪ বছরে আকাশের চাঁদ-তারা, বৃষ্টি দেখতে পাননি তারা মনভরে। আলো-আঁধারির খেলা ছিল তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। তাদের ভাষায়, কারাগারের ভেতর আরেক কারাগার হলো কনডেম সেল।
প্রতিদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে দুজনের। সেখানে কেবলই মৃত্যুর প্রহর গোনা। চোখের সামনে দেখেছেন মৃত্যুশঙ্কায় কুঁকড়ে থাকা মানুষের মুখ। বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে থাকা প্রায় দুই হাজার মানুষের গল্প আলাদা, কিন্তু রকম একই।
রায়ের পরই দুজনকে পাঠানো হয় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেল এরিয়ার ৬ নম্বর সেলের আলাদা দুটি কক্ষে। একেক কক্ষে থাকত চার থেকে পাঁচজন। ৮ ফুট বাই ১০ ফুট জায়গা। ১৪ বছরের কনডেমড জীবনের বিভিন্ন সময়ে সেল পরিবর্তিত হলেও পরিস্থিতি বা পরিবেশের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।সোনারুদ্দি ও ইসমাইল বলতে থাকেন, প্রথমে মনে হয়েছিল মানিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু হয়নি।
ওই কারাগারের কনডেম সেলের পরিবেশ ছিল দোজখের মতো। এক সময় মনে হতো এর চেয়ে মৃত্যু ভালোÑ সব যন্ত্রণার অবসান। মানুষ মরবে ঠিক, কিন্তু প্রতিদিন কি মানুষ মরে! মাথার ওপর দেয়ালে একটি ছোট্ট ভেন্টিলেটর। সেটি থাকা না-থাকা সমান কথা। ভেতরে বিদ্যুতের আলো ছিল, সূর্যের আলোর কোনো বালাই নেই। পুরো কক্ষে গুমোট আর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। বাতাস নেই। একপাশে হাঁটুসমান উঁচু একটি টয়লেট। দুর্গন্ধ ছড়ায় সারাক্ষণ। তার পাশেই ফ্লোরে কম্বল বিছিয়ে আর একটি কম্বলকে মুড়িয়ে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমাতেন তারা।
(২০১৯ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে বালিশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ) কক্ষের সামনের দিকে একটি লোহার গেট। ফাঁকা বলতে ছোট একটু বারান্দা, তাও লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা।
তারা বলতে থাকেন, ‘খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়তেন। সকাল ৭টার আগেই নাশতা চলে আসত। এক ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হতো সেলের লোহার দরজা। সেল পার হয়ে একটু সামনে ট্যাপের পানিতে গোসল। নাশতা সেরে নিজেরাই বাসন পরিষ্কার করতেন। খাওয়া আর টয়লেটে ব্যবহারের জন্য পালা করে বালতিতে পানি বহন করে নিয়ে আসতে হতো সেলের ভেতরে।
প্রথমদিকে সকালের নাশতায় দেওয়া হতো এক টুকরো গুড় আর একটি রুটি। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নাশতায় পরিবর্তন আসে। তখন কোনো কোনো দিন রুটি, সবজি, হালুয়া ও খিচুড়ি পেতেন নাশতা হিসেবে। নাশতা শেষ হতে হতে বন্ধ করে দেওয়া হতো লোহার দরজা। তখন কেউ কোরআন শরিফ নিয়ে বসতেন। পড়া শেষে মোনাজাতে কেবলই মৃত্যু থেকে মুক্তির প্রার্থনা।
এরপর সময় কাটাতে কেউ লুডু, দাবা নিয়ে বসতেন। টিভি দেখার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু শুধু বিটিভি ও বিটিভি চট্টগ্রাম (রাত ১০টায় আবার টিভি দেখা বন্ধ)। এভাবে কখন যে দুপুর চলে আসত!
সাড়ে ১১টার দিকে চলে আসত দুপুরের খাবার। কোনো কোনো দিন এক টুকরো মাছ, সবজি, ডাল, দুই টুকরো গরুর মাংস, এক টুকরো ব্রয়লার মুরগির মাংস। সপ্তাহের প্রতিটি দিন পালা করে এভাবেই খাবার দেওয়া হতো। দুপুরের খাবারের পর সাড়ে বেলা ৩টার দিকে আবার এক ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হতো সেল। বারান্দায় একটু হাঁটাহাঁটি করার ইচ্ছা থাকলেও নিজেদের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে হতো এই স্বল্প সময়ে।
ভেতরের টয়লেটের জন্য পালা করে পানি টানতে হতো বালতিতে। নির্ধারিত সময় পার হয়ে যেত এভাবেই। বন্দি ভেতরে থাক বা বাইরে আসুক, তাদের বিষয়ে কারারক্ষীদের কঠোর নজরদারি থাকত। রাতের খাবার দেওয়া হতো সন্ধ্যার আগেই। খাবারে থাকত ভাত, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস। খেয়ে নিতেন রাত ৮টার আগেই। এমনিতে ভালো আচরণ করলেও মাছ ও মাংসের টুকরো নিয়ে কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ করলে কেউ কেউ কটু কথা শোনাতেন। কারাগারে বিশেষ দিনের কথা মনে করে এখনো চোখ চক চক করে সোনারুদ্দি ও ইসমাইলের।
কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, বছরে দুটি ঈদ, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে ভালো খাবার মিলত। পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস, মিষ্টি, পান। যেদিন ভালো খাবার থাকে সেদিন সেলের সবাই খুব তৃপ্তি নিয়ে খেতেন। তখন খুব কষ্ট হতো বাড়ির জন্য, স্বজনদের জন্য।
মৃত্যুযন্ত্রণার দিনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করছিলেন ইসমাইল।
ছলছল চোখে বলেন, ‘২০১২ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা। দিন-তারিখ মনে নেই। প্রচন্ড শীত তখন। কারারক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে মায়ের পাঠানো ছাতু খেয়েছিলেন লুকিয়ে। এ নিয়ে তুলকালাম। খাবারের মানসহ নানা বিষয়ে আপত্তি-অভিযোগ ছিল। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হলো আমার বিরুদ্ধে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কারা কর্মকর্তা ও জমাদারের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হই। নেমে আসে শাস্তির খড়গ। এক সপ্তাহ পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরে থাকতে হয়। ’ তিনি আরও বলেন, ‘খুব শীতে লোহার ডান্ডা-াবেড়ি থাকত বরফের মতো ঠান্ডা। শরীরে লাগলে মনে হইত বরফের মতো জইম্যা গেছে। দোজখের যন্ত্রণা মনে হয় এইটাই।
’
ইসমাইল বলেন, ‘কনডেম সেলে থাকার সময় মনে হতো, যেকোনো সময় গলায় দড়ি পরবে। শুধু হুকুমের অপেক্ষা। কত দিন নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি ঠিক নেই। যখন হাইকোর্টের রায়ে ফাঁসি (২০১৪ সালের ১৩ মার্চ) বহাল থাকে, তখন কারারক্ষীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সদয় আচরণ শুরু করেন তারা। নিশ্চিত হয়ে যাই, আর বোধ হয় বাঁচার সম্ভাবনা নেই। পরিবারের সদস্যরা যখন সাক্ষাতে আসতেন, তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
তওবা করেছি অনেকবার। ফাঁসির মঞ্চটাও ছিল সেল থেকে মাত্র ১০ গজ দূরে। ’ ১৪ বছরের কনডেম সেল জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছেন ইসমাইল। তার ভাষায়, আগামী ১০০ বছর বেঁচে থাকলেও এ শিক্ষার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হবে না। ’ তিনি বলেন, ‘লেহাপড়া জানতাম না। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে লেহাপড়া শুরু করি। প্রতিদিন পেপার পড়ছি। বই পড়ছি। শুদ্ধ ভাষায় কথা কইতে পারি। ফাঁসির মামলা টানতে টানতে আইন-আদালতের সব শিখছি। পরিবাররেও পরামর্শ দিছি। সব হারাইছি। কিন্তু এই শিক্ষা কি কম?’
ইসমাইলের এখন থাকার জায়গা নেই। জেল থেকে বেরিয়ে তিন ভাইয়ের ঘরে পালা করে তিনবেলা খাচ্ছেন। রাতে থাকেন ছোট ভাইয়ের ঘরে। এখন কী হবে? কোথায় থাকবেন? কী খাবেন! মামলা চালাতে গিয়ে সব গেছে। শরীর গেছে নষ্ট হয়ে। কনডেম সেলে পানিভরতি ভারী বালতি টানতে গিয়ে কোমরে এখনো ব্যথা পান তিনি। নতুন করে জীবন রাঙাতে চান। কিন্তু জেল খাটা আসামিকে বিয়ে করবে কে? ইসমাইল বলেন, ‘একটা কাজ করে খেতে চাই। বিয়ে করে সংসার করতে চাই। জীবনকে শুদ্ধ করতে চাই।
’
কনডেম সেলে যাওয়ার পর সোনারুদ্দির কাছে একটি চিঠি দিয়েছিল তার ছোট মেয়ে মিনু আক্তার। ২০১৫ সালে তাকে পাঠানো হয় গাজীপুরের হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে। কারাগারটি রাজশাহী কারাগারের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। জেলে বসেই তিন মেয়ের বিয়ের খবর পান। ছেলে আব্দুল্লাহ (২৪) এখন অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন। স্ত্রী জোলেখা বেগম (৪৬) চেয়ে-চিন্তে এত দিন টেনেছেন। আর পারছেন না। সোনারুদ্দি বলেন, খুব কাছ থেকে দেখেছেন মৃত্যুযন্ত্রণা। তার ভাষায়, ফাঁসির আসামিদের বেশির ভাগ মানসিকভাবে খুব দুর্বল থাকে। সকাল, দুপুর, রাতে বন্দিদের অনেকেই হাউমাউ করে কাঁদতেন। নির্দোষ দাবি করতেন।
মৃত্যুযন্ত্রণায় অনেকের অস্বাভাবিক আচরণে রাতে কতবার যে ঘুম ভেঙেছে ইয়ত্তা নেই। তখন এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হতো। মনে হতো, এটা পৃথিবীর বাইরে ভিন্ন একটি জগৎ। যেখানে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু হয়।
ঘুমের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতেন ফাঁসির কাষ্ঠের সামনে। তিনি বলেন, কনডেম সেলে থাকার সময় খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে খাওয়া পড়ার দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে। ওই জায়গা থেকে মুক্তি পেলেও জীবন থেকে মনে হয় মুক্তি নেই।