প্রতিনিধি ২১ অক্টোবর ২০২৪ , ১২:২০:৫১ প্রিন্ট সংস্করণ
বরিশাল ব্যুরো।।প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে।এ সময় মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম মেঘনা নদী।বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত এ নদীর ২২ কিলোমিটার অভয়াশ্রমভুক্ত।এলাকাটি মৎস্য অধিদপ্তরের ভাষায় ‘ইলিশ প্রজননের হটস্পট’।কিন্তু প্রতিবছর নিষেধাজ্ঞা চলাকালে এই হটস্পট অশান্ত হয়ে ওঠে।নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দিনরাত ইলিশ নিধন ও প্রকাশ্যে বিক্রি করছেন জেলেরা।বাধা দিতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের লোকদের ওপর হামলা যেন নিয়মিত ঘটনা।এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।তবে এক ধাপ এগিয়ে জেলেদের কাছে টোকেন বিক্রি করছেন প্রভাবশালীরা।

গতকাল রোববার ছিল নিষেধাজ্ঞার অষ্টম দিন।এরই মধ্যে হিজলা উপজেলায় মেঘনায় দুই দফা হামলার শিকার হয়েছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।গত বৃহস্পতিবার রাতে গৌরবদী ইউনিয়নসংলগ্ন ওরাকুল এলাকায় অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হন ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মো. এমদ্যাদুল্লাহসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। শুক্রবার বিকেলে র্যাবসহ একই স্থানে গেলে ফের হামলার মুখে পড়েন তারা।কর্মকর্তাদের বহনকারী স্পিডবোট ভাঙচুর করা হয়।পরিস্থিতি সামাল দিতে ১১ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।এ ঘটনায় হিজলা থানায় মামলা হয়েছে।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও অভিযানে গেলে জেলেরা বাধা দিচ্ছেন।বিশেষ করে দড়িচর-খাজুরিয়া এলাকার কালাবদর নদীতে হামলা বেশি হয়।
হিজলার স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন,নদী এখন জেলেদের দখলে।দুর্গম চরগুলোতে রাতে পাইকারি ইলিশ বেচাকেনার হাট বসে।কোটি টাকার বেশি ইলিশ বেচাকেনা হয়।
কেন এই পরিস্থিতি
মৎস্যজীবী সংগঠক ও সচেতন ব্যক্তিরা জানান,দুই উপজেলায় বড় দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা প্রায় সবাই ইলিশ ব্যবসায়ী।ক্ষমতাসীন দলের নেতারা হন মেঘনার সম্পদের নিয়ন্ত্রক।গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপন করলে সব নিয়ন্ত্রণে নেন বিএনপির লোকজন।
গত ১৬ বছর অপকর্মের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম মিলন।৫ আগস্টের পর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার,জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আলতাফ হোসেন খোকন দপ্তরী ও সদস্য সচিব মনির দেওয়ানের নিয়ন্ত্রণে চলছে সব।
মেহেন্দীগঞ্জের গৌরবদী ও হরিনাথপুর ইউনিয়নসংলগ্ন মেঘনার অপর প্রান্ত শরীয়তপুর,ভোলা ও চাঁদপুরের হাইমচর এলাকা। মাঝের বিশাল মেঘনা ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের কেন্দ্রবিন্দু বা ইলিশের ‘খনি’। ওই এলাকায় প্রকাশ্যে ডাক হেঁকে পাইকারি বিক্রি হয় ইলিশ।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওরাকুল,জানপুর,সাতপাড়া, অন্তধাম এলাকা এবার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন হিজলা বিএনপির শীর্ষ তিন নেতা।আবুপুর গঙ্গাপুর ছয়গা,বদরপুর,বিষকাঠালী এলাকা হরিনাথপুর ইউনিয়ন বিএনপির নেতাদের আবদুল খালেক মাঝির নিয়ন্ত্রণে।
দেওয়া হয়েছে টোকেন
নদীতে মাছ ধরার জন্য এবার স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা জেলেদের কাছে টোকেন বিক্রি করেছেন।প্রতিদিন মাছ ধরার জন্য ২ হাজার টাকা অথবা টানা ২২ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৪ লাখ টাকা করে একটি টোকেন বিক্রি হচ্ছে।টোকেন না নিলে জেলেদের নদী থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়।
জানা গেছে,টোকেন বিক্রির অর্ধেক টাকা নেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা।অবশিষ্ট টাকার সাড়ে ৫ ভাগ নেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার এবং জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক খোকন দপ্তরী ও সদস্য সচিব মনির দেওয়ান নেন ৪ ভাগ। এর পর উদ্বৃত্ত টাকা উপজেলা ছাত্রদল,যুবদল ও শ্রমিক দল নেতাদের মধ্যে বণ্টন হয়।
হরিনাথপুরের খালেক মাঝি বলেন,তিনিও জেলেদের হাতে টোকেন আছে বলে শুনেছেন।কারা দিয়েছেন জানেন না। সব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার বলেন,হিজলার ইতিহাসে এবার সবচেয়ে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা পালন হচ্ছে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মহাসচিব ইকবাল বলেন,ট্রলারের মাঝিরা প্রভাবশালীদের সোর্স হিসেবে কাজ করেন।কোস্টগার্ড কিংবা নৌবাহিনীর জাহাজ থাকলে পুরো মেঘনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর আলম বলেন,মেঘনায় ২২ দিনের দুর্বৃত্তায়ন ঠেকাতে নৌবাহিনী প্রয়োজন।
মেহেন্দীগঞ্জের ইউএনও নেছার উদ্দিন বলেন,বিশাল মেঘনার পাহারা দিতে প্রশাসনের জলযান ও জনবল কিছুই নেই। অভিযানে যেতে যে ট্রলার নেওয়া হয়,তার মাঝিই জেলেদের সোর্স হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প পরিচালক এমদ্যাদুল্লাহ বলেন,কয়েক বছরের চেয়ে এবার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।মেঘনার ওরাকুল পয়েন্টে নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ডের স্থায়ী জাহাজ স্থাপনের বিষয়টি মৎস্য উপদেষ্টাকে বলেছি; আবারও বলব।

















