জাতীয়

দীর্ঘ পাইপলাইনে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০ বছর সরবরাহের জন্য বর্তমানে আবিষ্কৃত গ্যাস যথেষ্ট নয়

  প্রতিনিধি ৩০ এপ্রিল ২০২৩ , ৪:৩৪:০৪ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।গ্যাস নিয়ে সরকারের বড় পরিকল্পনাও রয়েছে।এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা।ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত একটি এবং পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত আরেকটি পাইপলাইন করা এই পরিকল্পনার অংশবিশেষ।তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ভোলা অঞ্চলে কী পরিমাণ গ্যাস মজুত থাকতে পারে,তা নির্ধারণ করা।দীর্ঘ পাইপলাইনে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০-২৫ বছর সরবরাহের জন্য বর্তমানে আবিষ্কৃত গ্যাস যথেষ্ট নয়।

গ্যাস বিতরণ পাইপলাইনের বেশুমার ছিদ্রপথে ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকার প্রতিবেশে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার অদৃশ্যপূর্ব ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ভোলায় একটি অনুসন্ধান কূপে (ইলিশা-১) গ্যাস পাওয়ার খবরটি নিঃসন্দেহে সুখবর।এ সুখবরটি পাওয়া গেছে গত শুক্রবার।অবশ্য সেখান থেকে এমন খবর আসাটাই প্রত্যাশিত ছিল।

কারণ,ওখানে যে গ্যাস আছে,সে বিষয়ে বাপেক্সের ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে আগেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। বাকি ছিল শুধু সেখানকার ভূগর্ভে চার কিলোমিটারের মতো গর্ত খুঁড়ে গ্যাসের স্তর পর্যন্ত পৌঁছানো।সে কাজটিও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।এখন ওই কূপে ‘স্টেম টেস্ট’সহ কিছু বিশেষায়িত কারিগরি কর্মকাণ্ড শেষে ওখানে গ্যাসের প্রাপ্যতা ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে স্পষ্ট করে জানা যাবে।সে জন্য হয়তো সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হবে।

ইলিশা-১ কূপে গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার পর এখন ভোলায় গ্যাসকূপের সংখ্যা দাঁড়াল ৯। এবার ৩টি কূপ খনন করেছে রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রম।এর আগে ৬টি কূপ খনন করেছে বাপেক্স নিজে।সরকারের প্রাথমিক হিসাবে এই ৯টি কূপে মোট গ্যাস রয়েছে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের (টিসিএফ) মতো।তবে বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এই ৯টি কূপে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে।

বর্তমানে দেশে প্রতিবছর গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১ টিসিএফ।ভোলা গ্যাসক্ষেত্রটি বাপেক্সই আবিষ্কার করেছিল প্রায় ২৬ বছর আগে।প্রথমে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছিল ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার শাহবাজপুরে।এরপর তা দ্বীপটির উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।বিশেষজ্ঞদের অভিমত—ভোলার দক্ষিণে মনপুরাসহ বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলো এবং মেঘনা নদীবক্ষেও বিপুল গ্যাসের মজুত রয়েছে। এসব এলাকায় নিবিড় অনুসন্ধান চালানো দরকার।

দুই
ইলিশা-১ অনুসন্ধান কূপে গ্যাস পাওয়ার খবরে আমরা আরও বেশি উচ্ছ্বসিত হতে পারতাম যদি কূপটি বাপেক্স খনন করত। এ রকম একটি কূপ খনন করার জন্য রিগসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি,জনবল,অর্থ সবই বাপেক্সের ছিল।কিন্তু কাজটি বাপেক্স নিজে করেনি।তার ঠিকাদার হিসেবে কাজটি করেছে রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রম।ফলে আমাদের বাড়তি প্রাপ্তি হয়েছে কিছু বাড়তি অর্থ ব্যয়।বাপেক্স নিজে কাজটি করলে বড়জোর ব্যয় হতো ১০ মিলিয়ন (১ কোটি) মার্কিন ডলার। আর গাজপ্রমকে দেওয়া হচ্ছে ২১ মিলিয়নেরও কিছু বেশি (৩টি কূপের জন্য ৬৩ দশমিক ৫৮৫২১৮ মিলিয়ন ডলার)।

দেশের বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীরা সব সময়ই বলে এসেছেন, ভোলায় এ রকম কূপ খননের জন্য বিদেশি কোম্পানি নিয়োগ অহেতুক।এ ধরনের কূপ খননের জন্য বাপেক্সই যথেষ্ট। তারপরও যেসব যুক্তিতে গাজপ্রমকে সেখানে এখন ৩টি কূপ (টগবি,ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২) খননের কাজ দেওয়া হয়েছে,তা কখনোই তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

আসলে গাজপ্রম ভোলার মতো কোনো আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে অন্য কারও ঠিকাদার হিসেবে কূপ খনন করার মতো কোম্পানি নয়।প্রকৃতপক্ষে ঠিকাদারি নেওয়া বা পাওয়ার পরও গাজপ্রম নিজে এগুলো করেও না।সাধারণত এ ধরনের কাজ তারা অন্য কোনো ছোট কোম্পানিকে সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে করায়।যেমন আমাদের দেশে করাচ্ছে আজারবাইজানের কোম্পানি অ্যারিয়েলকে দিয়ে।ভোলায় বর্তমান তিনটি কূপের আগেও গাজপ্রম এখানে দুই দফায় ১৭টি কূপ খনন করেছে। সেগুলোও করেছে আসলে অ্যারিয়েল।গ্যাস খাতে কারিগরি ও আর্থিক সামর্থ্যের দিক দিয়ে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দু-তিনটি কোম্পানির একটি হচ্ছে গাজপ্রম।নিজ দেশ রাশিয়া ও বহির্বিশ্বের বিশাল এবং জটিল সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, উন্নয়নের মতো মৌলিক কাজ নিয়েই তাদের যত ব্যস্ততা। আমাদের দেশেও বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে তেমন কাজই গাজপ্রমের করার কথা।অন্তত সরকারের পক্ষ থেকে এমনটাই নানা সময়ে বলা হয়েছে।রাশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে এ-সংক্রান্ত সমঝোতাও হয়ে আছে।

তারপরও বাংলাদেশে কেন তারা বারবার কূপ খননের কাজের ঠিকাদারি নেয় এবং কেনই-বা বেশি অর্থ ব্যয়ে দেওয়া হয়—এ প্রশ্ন বহুবার উঠেছে।কিন্তু যৌক্তিক জবাব মেলেনি।বাংলাদেশে রাশিয়ার দূতাবাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে একবার এ প্রশ্নটি করার সুযোগ পেয়েছিলাম।তাঁর সাফ জবাব ছিল,গাজপ্রমের আগ্রহে এখানে কূপ খননের ঠিকাদারি নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ সরকার গাজপ্রমকে এ কাজ দিতে চায় বলেই নিতে হয়।কেন সরকার সেটা চায়,তা সরকারই বলতে পারবে।

তিন
ভোলার গ্যাস দেশের চলমান গ্যাস-সংকট নিরসনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।কারণ,ওই গ্যাস দেশের মূল ভূখণ্ডে সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই।গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর ভোলায় যে ৬টি কূপ খনন করা হয়েছে,সেগুলোর দৈনিক মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ১২০ মিলিয়ন (১২ কোটি) ঘনফুট।কিন্তু বিদ্যমান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বর্তমানে ভোলায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট,যা ৩টি কূপ থেকেই সরবরাহ করা যায়।ফলে অবশিষ্ট ৩টি কূপ অলস পড়ে আছে।এর পাশাপাশি এখন আরও ৩টি নতুন কূপ খনন সম্পন্ন হয়েছে।ফলে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ব্যবহার সীমিত।

সরকার অবশ্য ভোলার কিছু গ্যাস সিএনজি আকারে সিলিন্ডারে করে ঢাকা এবং এর আশপাশের সংকটাপন্ন এলাকার শিল্প-কারখানায় সরবরাহের পরিকল্পনা করেছে।সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও চলমান।কিন্তু তাতে দেশের চলমান গ্যাস-সংকট সমাধানে যেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হবে না,তেমনি ভোলার গ্যাসেরও ব্যবহার খুব একটা বাড়বে না।

অবশ্য ভোলা অঞ্চলে গ্যাসের বিপুল মজুত সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী।আমাদের দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দুটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো সম্ভাবনাময়।এর একটি সুরমা বেসিন। অন্যটি বেঙ্গল বেসিন।বৃহত্তর সিলেট,কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,নরসিংদীসহ যেসব এলাকায় বিদ্যমান সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে,এর সবই সুরমা বেসিনের অন্তর্ভুক্ত। মূলত ওই অঞ্চলেই অনুসন্ধান,আবিষ্কার ও উত্তোলন করে আসা হয়েছে।

সেই তুলনায় বেঙ্গল বেসিনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অবহেলিত বা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।ফলে একমাত্র ভোলা ছাড়া বেঙ্গল বেসিনে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আবিষ্কার হয়নি। অথচ ভূতাত্ত্বিক,ভূপদার্থবিদ,বিশেষজ্ঞ গবেষক ও প্রকৌশলীরা বেঙ্গল বেসিনকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করেন।তাঁদের মতে,এই বেসিনভুক্ত ভোলা এবং এর আশপাশের মনপুরাসহ অন্যান্য দ্বীপাঞ্চল,মেঘনা নদীবক্ষ প্রভৃতি অঞ্চলে গ্যাসের সম্ভাব্য মজুত দেশের জ্বালানি খাতের চেহারা বদলে দিতে পারে।তাঁরা মনে করেন,দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসের চেয়ে অনাবিষ্কৃত মজুত বেশি।শুধু প্রয়োজন অনুসন্ধান করে তা আবিষ্কার করা।তবে এই বিশাল কর্মকাণ্ড একা বাপেক্সের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

চার
এই পটভূমি বিবেচনায় এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়—টগবি, ভোলা নর্থ ও ইলিশা-১ কূপে গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার চেয়ে দেশবাসী অনেক বেশি আনন্দিত হতে পারত যদি খবর আসত মেঘনা নদীবক্ষ এবং ভোলার সন্নিহিত দ্বীপাঞ্চলগুলো অনুসন্ধান করে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করা গেছে।জ্বালানি নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে তাতে দেশবাসী অনেক নিরাপদও বোধ করত।সরকারও নিশ্চয়ই দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানির সংকট থেকে মুক্তির সম্ভাবনায় হাঁপ ছেড়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারত।

আগেই বলেছি,এই কাজ বাপেক্সের একার পক্ষে করা অসম্ভব।এ জন্য দরকার গাজপ্রমের মতো কোনো অংশীদারের সহযোগিতা।সেই সহযোগিতার সম্ভাবনার কথাও আমরা অনেক শুনেছি।কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন কিছু।ফলে দেশ ক্রমাগত জ্বালানি আমদানির বিপজ্জনক নির্ভরশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।দেশের জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন না করা হলে আমদানির এই ঝোঁক আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা বলা খুব মুশকিল।

আরও খবর

Sponsered content