জাতীয়

হাজারো বিদেশগামী নাগরিক ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়

  প্রতিনিধি ৫ মে ২০২৩ , ৪:০৭:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ঢাকার মিরপুর এলাকার এক নারী চলতি বছরের শুরুতে স্বামীর সঙ্গে পর্তুগাল গেছেন।যাওয়ার আগে হালকা যানবাহন চালানোর জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে।লাইসেন্স সরবরাহের তারিখ ছিল গত ২৬ এপ্রিল।তবে সে তারিখে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।পরিবর্তিত তারিখ আগামী ১৩ জুলাই।কিন্তু নতুন তারিখেও লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে শঙ্কা আবেদনকারীর বাবার।গত ২৬ এপ্রিল বিআরটিএর সহকারী পরিচালকের কক্ষে লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে শঙ্কার কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন তিনি।

এ রকম হাজারো বিদেশগামী নাগরিককে লাইসেন্স নিয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়।এর বাইরেও ভুক্তভোগীর তালিকায় আছেন পেশাদার চালক,সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে চালক পদে আবেদনকারীরাও।

বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে গত ২৬-২৭ এপ্রিল গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত সময়ে লাইসেন্স না পাওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসা কয়েক শ মানুষের ভিড়। কিন্তু তারিখ পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই জানাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ওই কর্মকর্তাদের দাবি, লাইসেন্স কার্ড মুদ্রণ না হওয়ায় নতুন তারিখ দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই তাঁদের।

গত রোববার বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গিয়েও দেখা যায়, লাইসেন্স-সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে ভিড় করেছেন ১৫-২০ জন। তাঁদেরই একজন পর্তুগালগামী খাদিজা আক্তার বলেন, ‘আমার ১ মে তারিখের টিকিট কাটা হয়েছে বিমানের। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি “রেডি টু প্রিন্ট” (ছাপার জন্য প্রস্তুত) লেখা এসএমএস পেয়েছি। তবে লাইসেন্স পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা পাইনি। এ নিয়ে চারবার এখানে এসেও কোনো সদুত্তর পাইনি। লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে “রেডি টু ডেসপাস” লেখা থাকবে।’

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, একটি লাইসেন্স পেতে আবেদনকারীর ছয় মাস বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। কারণ যাদের সঙ্গে এই চুক্তি করা হয়েছে, তারা সময়মতো লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারছে না। এখন দালালের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমলেও সময়মতো লাইসেন্স সরবরাহ নিয়ে সংকটে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের এক সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া এখন তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের হাতে। লাইসেন্স প্রস্তুত না হলে বিআরটিএ শুধু প্রদানের সময় পরিবর্তন করে।’

বিআরটিএ ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর এবং গত ২ মার্চ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, লাইসেন্স কার্ড না পেলেও অস্থায়ী অনুমতিপত্র বা ই-পেপার ব্যবহার করতে পারবেন চালক।
সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আশা করছি, আগামী এক মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে। এলসি (ঋণপত্র) জটিলতায় লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি কোম্পানি। এখন লাইসেন্স কার্ড না পেলেও সমস্যা হয় না, কারণ ই-পেপার দেওয়া হচ্ছে। শুধু দেশের বাইরে যাঁরা যাবেন, তাঁদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।’

৪০ লাখ লাইসেন্স সরবরাহ করবে এমএসপি
জানা যায়, মোটরযানের লাইসেন্স হিসেবে ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্টকার্ড তৈরির জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এমএসপি প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০২০ সালের ২৯ জুলাই। ব্যয় ধরা হয় ১২০ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই। এই সময়ের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী ৪০ লাখ লাইসেন্স কার্ড সরবরাহ করার কথা প্রতিষ্ঠানটির। প্রতিটি কার্ডে খরচ ধরা হয় ৩০০ টাকা ১৫ পয়সা। চাহিদা অনুযায়ী কার্ডগুলো সরবরাহ করার কথা বিআরটিএর সব কার্যালয়ে।

এর আগে ২০১৬ সালে লাইসেন্স কার্ড সরবরাহের জন্য ‘টাইগার আইটি’র সঙ্গে চুক্তি করেছিল বিআরটিএ। ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে তাদের ১৫ লাখ কার্ড তৈরির কথা ছিল। তবে চাহিদা বাড়ায় প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত চুক্তির তিন বছরে সাড়ে প্রায় ১৪ লাখ কার্ড সরবরাহ করে। চুক্তির আগেই কার্ডপ্রাপ্তি এবং পরে টাইগার আইটির ব্যবসায়িক সমস্যার কারণে নতুন দরপত্র আহ্বান করে বিআরটিএ।

জানা যায়, দরপত্র আহ্বান থেকে নতুন চুক্তি করার সময়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ লাইসেন্সের আবেদন জমা পড়ে। এমএসপি দায়িত্ব নেওয়ার পর জানায়, এই সময়ের কার্ডের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না টাইগার আইটি থেকে। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট এই লাইসেন্সগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে (বিএমটিএফ)।

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, চুক্তির পর তিন বছরে ২৪ লাখ লাইসেন্স সরবরাহ করার কথা এমএসপির। তবে গত এপ্রিল পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে সাড়ে ৫ লাখের কিছু বেশি। গত মার্চ পর্যন্ত এমএসপির কাছে লাইসেন্সের আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার। তারা জানায়, এলসির কারণে স্মার্ট লাইসেন্স কার্ড দেশে আনা যাচ্ছে না।

সূত্রমতে, গত এক মাসে লাইসেন্স সরবরাহের হার বাড়েনি। বরং আবেদন জমার পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বিএমটিএফের কাছে জমা আছে ১ লাখ ৭০ হাজারের মতো আবেদন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ আবেদন জমা আছে।

বিআরটিএর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রিন্টিং কোম্পানি এখন তাদের বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। লাইসেন্সের জন্য যেখানে বায়োমেট্রিক নেওয়া হয়, সেখানেও ঘুষ ও দালালের দৌরাত্ম্য আছে।

বছরে গড়ে ৮ লাখ কার্ড সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আসলে চুক্তির একটা প্রক্রিয়া থাকে। এত লাইসেন্স তো বছরে দরকার হয়নি। সব মিলিয়ে ১০-১২ লাখ লাইসেন্স এই তিন বছরে প্রয়োজন হয়েছে। এর মধ্যে ৫ লাখ পেন্ডিং। সেটাও এক মাসে সমাধান হবে।’

এলসি জটিলতার অজুহাত
এমএসপি কর্মকর্তাদের দাবি, এলসি জটিলতায় কার্ড আসছে না। তবে এ দাবি মানতে নারাজ বিআরটিএর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের কার্ড বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে এলসি কোনো সমস্যা হতে পারে না। কারণ তারা নিজেদের জিনিসই বাংলাদেশে আনছে। এমন বাহানা তারা কেন দেয়? যদিও বিআরটিএ সেটি মেনে নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ঈদের আগে ৬ লাখ কার্ড দেশে এসেছে আইপির (আমদানি অনুমতি) মাধ্যমে। সেগুলো ঢাকা বিমানবন্দরে আছে। কমপক্ষে ১৫ দিন লাগবে খালাস করতে। এরপর হয়তো কিছু লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারে।’

ঠিকাদার কোম্পানির কাছে জিম্মি হওয়ার বিষয়টি ফুটে ওঠে আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জবানিতে। তিনি বলেন, ‘তারা কার্ড না দিলে কী করার আছে? তাদের শোকজ করা হয়েছে। চাপে রাখা হয়েছে। এখন মামলা করলে তো আর কার্ডই পাওয়া যাবে না। এতে আরও দেরি হবে।’

আঙুলের ছাপ নিতেও ভোগান্তি
এমএসপি বায়োমেট্রিক (আঙুলের ছাপ) নেয় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে অস্থায়ী কার্যালয়ে। গত ২৭ এপ্রিল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বায়োমেট্রিক দিতে আসা চালকদের দীর্ঘ সারি। শুধু সরকারি কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রভাবশালী কারও আবদার নিয়ে গেলে দ্রুত বায়োমেট্রিক নেওয়া হয়। সাধারণ চালকদের বায়োমেট্রিক দেওয়া রীতিমতো যুদ্ধের মতো।
এ বিষয়ে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক আশরাফ বিন মুস্তফা বলেন, ‘আমদানি অনুমতিতে ৬ লাখ কার্ড বিমানবন্দরে এসেছে। বিশেষ কারণে এই আইপি দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এগুলো ছাড় পাবে। আটটি মেশিনে দিনে আট হাজার কার্ড প্রিন্ট হবে। আশা করা যাচ্ছে, এক মাসের মধ্যেই পেন্ডিংগুলোর সমাধান হবে।’

আরও খবর

Sponsered content